তাফসীরের আব্দুল হান্নান

তাফসীরে আব্দুল হান্নান

রচনায়ঃআব্দুল হান্নান

سورة الفَاتِحَة بِسۡمِ اللّٰہِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِ পরম করুনাময় আল্লাহর নামে শুরু করছি
اَلۡحَمۡدُ لِلّٰہِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ০ ১।সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য যিনি সমগ্র বিশ্ব –জাহানের প্রতিপালক।
الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡم ২।যিনি পরম দয়ালু ও করুণাময়,
مٰلِکِ یَوۡمِ الدِّیۡن
৩।প্রতিদান দিবসের মালিক
إِيَّاكَ نَعْبُدُ وإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ ৪।আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদাত করি এবং একমাত্র তোমারই কাছে সাহায্য চাই
اهدِنَــــا الصِّرَاطَ المُستَقِيمَ ৫। তুমি আমাদের সোজা পথ দেখাও
, صِرَاطَ الَّذِينَ أَنعَمتَ عَلَيهِمْ ৬। তাদের পথ যাদের প্রতি তুমি অনুগ্রহ করেছ
غَیۡرِ الۡمَغۡضُوۡبِ عَلَیۡہِمۡ وَ لَا الضَّآلِّیۡنَ ৭।যাদের ওপর গযব পড়েনি এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়নি।
নামকরন
১।এ সূরার ভিতরের বক্তব্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই এর এই নামকরণ করা হয়েছে । যার মাধ্যমে কোন বিষয়, গ্রন্থ বা জিনিসের সূচনা করা হয় তাকে ফাতিহা বলা হয় । অন্য কথায় বলা যায় , এ শব্দটি ভূমিকা এবং বক্তব্য শুরু করার অর্থ প্রকাশ করে ।
২।এই সূরার মাধ্যম দিয়ে আল্লাহ তায়ালা মানব জাতীর জীবনের চুড়ান্ত সফলতার আভাস দিয়ে যেন বলতে চাচ্ছেন" হে মানব জাতী তোমাদের মাঝে এমন একটি জিনিষ এসে গেছে, যার অনুস্বরন অনুকরন এবং প্রার্থনা পদ্ধতির বাস্তবায়ন তোমাদের জীবন থেকে সরিয়ে দিবে আযাব গজব পাঁপ পংঙ্কিলতা এনে দিবে চুড়ান্ত বিজয় "এ দিক থেকে এ সূরার নাম করন করা হয়েছে الفَاتِحَة
শানেনুযুলঃ
মক্কী জিন্দেগীতে নবীজির উপর প্রথম ওহীর সূচনা হয়।সবেমাত্র কিছু বিচ্ছিন্ন আয়াত নাযিল হয়েছে পূর্নাঙ্গ সূরা এখনো নাযিল হয়নি।
سورة الفَاتِحَة
এটিই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত লাভের একেবারেই প্রথম যুগের পূর্নাঙ্গ সূরা । হাদীসের নির্ভরযোগ্য বর্ণ না থেকে জানা যায়, এটিই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর নাযিলকৃত প্রথম পূর্ণাঙ্গ সূরা। এর আগে মাত্র বিছিন্ন কিছু আয়াত নাযিল হয়েছিল । সেগুলো সূরা আলাক, সূরা মুয্‌যাম্‌মিল ও সূরা মুদ্‌দাস্‌সির ইত্যাদিতে সন্নিবেশিত হয়েছে।
বিষয়বস্তু
আসলে এ সূরাটি হচ্ছে একটি দোয়ার দরখাস্ত ।এর মাধ্যমে আল্লাহ মানব জাতীকে বোঝাতে চাচ্ছেন যে, যদি যথার্থই এ গ্রন্থ থেকে তুমি লাভবান হতে চাও,হেদায়েতের পথ পেতে চাও তাহলে সমগ্র বিশ্ব-জাহানের মালিক আল্লাহর কাছে দোয়া এবং সাহায্য প্রার্থনা করো । ওহীর প্রাথমিক পর্যায়ে বিশ্বনবী এবংতিনার হাতে গুনা সাহাবীরা ওহীর দাওয়াত দিতে গিয়ে কাফের মুশরেকদের পক্ষ থেকে অনেক নির্যাতন অনেক অপবাদ এবং বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছিলেন তখন সাহাবীরা এক পর্যায়ে হতাশার ভিতর দিন কাটাচ্ছিলেন।কারণ তখনো পুরা কোরআন নাযিল হয়নি।নবী এবং সাহাবীরা তখনো জানতেন না যে কোরআনের কি বিধান তাদের উপর নাযিল হবে।স্বভাবতই মনের ভিতর তিনাদের একটা সুন্দর মতাদর্শ পথপ্রাপ্তির আকাংখা ছিল।তাছাড়াও আল্লাহ রববুল আলামিনের একটা অভিপ্রায় যে আমার সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল সঃ এর নিকট সর্বশেষ হেদায়েতের কিতাব অবতীর্ন করতে যাচ্ছি।তো কোন পদ্ধতিতে তারা এই হেদায়েতটা পাবে তার একটা প্রার্থনা পদ্ধতি আল্লাহ এই সূরার মাধ্যম দিয়ে শিক্ষা দিয়ে গোটা মানবতাকে জানিয়ে দিলেন যে, তোমরা আমার নিকট এভাবে দরখাস্ত পেশ করো।আর তোমাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে গোটা কোরাআন আমি তোমাদের সামনে পেশ করলাম। মওদুদী রঃ তাফসীরটি এভাবে করেছেন‘ মানুষের মনে যে বস্তুটির আকাংখা ও চাহিদা থাকে স্বভাবত মানুষ সেটিই চায় এবং সে জন্য দোয়া করে । আবার এমন অবস্থায় সে এই দোয়া করে যখন অনুভব করে যে, যে সত্তার কাছে সে দোয়া করছে তার আকাংখিত বস্তুটি তারই কাছে আছে । কাজেই কুরআনের শুরুতে এই দোয়ার শিক্ষা দিয়ে যেন মানুষকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, স ত্য পথের সন্ধান লাভের জন্য এ গ্রন্থটি পড়, সত্য অনুসন্ধানের মানসিকতা নিয়ে এর পাতা ওলটাও এবং নিখিল বিশ্ব- জাহানের মালিক ও প্রভু আল্লাহ হচ্ছেন জ্ঞানের একমাত্র উৎস একথা জেনে নিয়ে একমাত্র তাঁর কাছেই পথনির্দেশনার আর্জি পেশ করেই এ গ্রন্থটি পাঠের সূচনা কর । এ বিষয়টি অনুধাবন করার পর একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, কুরআন ও সূরা ফাতিহার মধ্যকার আসল সম্পর্ক কোন বই ও তার ভূমিকার সম্পর্কের পর্যায়ভুক্ত নয়। বরং এ মধ্যকার আসল সম্পর্কটি দোয়া ও দোয়ার জবাবের পর্যায়ভুক্ত । সূরা ফাতিহা বান্দার পক্ষ থেকে একটি দোয়া । আর কুরআন তার জবাব আল্লাহর পক্ষ থেকে । বান্দা দোয়া করে, হে মহান প্রভু! আমাকে পথ দেখাও । জবাবে মহান প্রভু এই বলে সমগ্র কুরআন তার সামনে রেখে দেন এই নাও সেই হিদায়াত ও পথের দিশা যে জন্য তুমি আমার কাছে আবেদন জানিয়েছ ।
তাফসীরঃ
بِسۡمِ اللّٰہِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِ আল্লাহ রববুল আ'লামিন بِسۡمِ اللّٰہِ না -বলে بِ এর স্থলে ا ব্যবহার করে سۡمِ اللّٰہِ ا বলতে পারতেন।এখানে بِ এর মধ্যে একটি গুঢ় রহস্য রয়েছে।আল্লাহর রাসূল সঃ বলেছেন সমগ্র কোরআনে যা আছে তা সূরা ফাতিহার ভিতর আছে।আর সূরা ফাতিহার ভিতর যা আছে তা বিসমিল্লাহর ভিতর আছে।আর বিসমিল্লাহর ভিতর যা আছে তা بِ এর ভিতর আছে। আর بِ এর ভিতর যা আছে তা আছে ب এর নীচের ফোটার মধ্যে। ইমাম মালেক রহঃবিসমিল্লাহর যে ব্যাক্ষা
করেছেন তাতে بِ এর নীচের ফোটার সাথে সৃষ্টি আর স্রষ্টার মাঝে পরিচিতির কথা বলেছেন।অর্থাৎ সৃষ্টি যদি না থাকতো তবে স্রষ্টাকে কেউ চিনতোনা,সৃষ্টির মাঝে পরিচিত হবার জন্যই স্রষ্টা সমগ্র্র বিশ্বকে সৃষ্টি করেছেন। بِ এর নীচের ফোটাটা যদি বাদ দেয়া হয় তাহলে ওটা কোন হরফের পরিচিতিিিই লাভ করবেনা শুধু মাত্র একটা বাঁকা দাগ দেখা যাবে অথচ ঐ বাঁকা দাগটির মধ্য্যে রয়েছে অসংখ্য বিন্দু বা ফোটা।বাঁকা দাগ টির ভিতর হতে একটি ফোটা নিয়ে যখনই বাঁকা দাগের উপরে নীচে দেয়া হবে তখনই একটা হরফের পরিচিতিি হবে।বিশ্ব জগৎ যখন ছিলনা তখন শুধুমাত্র আল্লাহর অস্তিত্বই বিরাজমান ছিল।আল্লাহ শুধু নিজের সত্তার নিকটেই পরিচিত ছিলেন,তিনি সৃষ্টি জগতের মাঝে পরিচিত হতে ভালো বাসলেন তাই সৃষ্টি জগৎ সৃষ্টি করলেন।দুনিয়াতে আল্লাহর বান্দার যখনই কোন কাজ করতে যাবে তখনই যেন بِسۡمِ اللّٰہِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِ পড়ে কাজ শুরু করে।আল্লাহ যেন তার বান্দাকে বুঝাতে চাচ্ছেন যে কোরআন بِسۡمِ اللّٰہِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِ দ্বারা শুরু হয়েছে অতএব তোমাদের জীবনের বৈধ কাজ গুলি তোমরা আল্লাহর নাম নিয়ে শুরু করো,بِسۡمِ اللّٰہِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِ এর মধ্যে যেমন সমগ্র কোরআনের পরিচিতি আছে তেমনি ভাবে তোমাকেও মনে করতে হবে কোরআন সামনে নিয়ে কাজটি আমি কোরআনের বিধান মোতাবেক بِسۡمِ اللّٰہِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِ বলে শুরু করতে যাচ্ছি । এই মানুষিকতা নিয়ে যে কাজ করবে তার দ্বারা কখনো অন্যায় কাজ করা সম্ভব নয়।
اَلۡحَمۡدُ لِلّٰہِ رَبِّ الۡعٰلَمِی نَ ۡ
প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য যিনি নিখিল বিশ্ব জাহানের রব, কোরআনুল কারীমের এমন অনেক বাক্য আছে যে গুলোর ব্যাক্ষা করা বান্দার সাধ্যের বাহিরে ।কোরআন নাযিলের পূ র্বে আরবের মুশরেকরা যখন কোন কাজ করতো তখন তাদের প্রিয় মুর্তিগুলোর নাম নিয়ে কাজ শুরু করতো ।একেক জন এক এক খোদার প্রশংসা গুনকীর্তন করতো।তাদের এই কুফরী মতবাদের মাথায় আঘাত হেনে ওহীর মাধ্যমে আল্লাহ গোটা মানবতাকে জানিয়ে দিলেন প্রশংসা ঐ আল্লাহর যিনি সমগ্র বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক ।তোমরা যাদের প্রশংসা করছো তারা কি তোমাদের নিজেদের কোন উপকারে আসে ?এখান থেকে শরীয়তের গুরুত্বপূর্ন একটা মাসআলার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে মুসলমান যেখানেই কোন কথা বলবে প্রথমেই আল্লাহর প্রশংসা করে তাকে কথা বলতে হবে ।ইসলাম মানুষকে একটি বিশেষ সভ্যতা ও সংস্কৃতি শিক্ষা দিয়েছে । প্রত্যেকটি কাজ শুরু করার আগে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা সভ্যতা ও সংস্কৃতির একটি রীতি । সচেতনতা ও আন্তরিকতার সাথে এ রীতির অনুসারী হলে অনিবার্যভাবে তিনটি সুফল লাভ করা যাবে । একঃ মানুষ অনেক খারাপ কাজ করা থেকে নিষ্কৃতি পাবে । কারণ আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা অভ্যাস তাকে প্রত্যেকটি কাজ শুরু করার আগে একথা চিন্তা করতে বাধ্য করবে য, যথার্থই এ কাজে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করার কোন ন্যায়সংগত অধিকার তার আছে কি না ৷ দুইঃ বৈধ সঠিক ও সৎকাজ শুরু করতে গিয়ে আল্লাহর নাম নেয়ার কারণে মানুষের মনোভাব ও মানসিকতা সঠিক দিকে মোড় নেবে । সে সবসময় সবচেয়ে নির্ভুল বিন্দু থেকে তার কাজ শুরু করবে । তিনঃ এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সুফল হচ্ছে এই যে, আল্লাহর নামে যখন সে কাজ শুরু করবে তখন আল্লাহর সাহায্য, সমর্থন ও সহায়তা তার সহযোগী হবে । তার প্রচেষ্টায় বরকত হবে । শয়তানের বিপর্যয় ও ধ্বংসকারিতা থেকে তাকে সং রক্ষিত রাখা হবে । বান্দা যখন আল্লাহর দিকে ফেরে তখন আল্লাহও বান্দার দিকে ফেরেন , এটাই আল্লাহর রীতি । ২ . ইতিপূর্বে ভূমিকায় বলেছি , সূরা ফাতিহা আসলে একটি দোয়া । তবে যে সত্তার কাছে আমরা প্রার্থনা করতে চাচ্ছি তাঁর প্রশংসা বাণী দিয়ে দোয়া শুরু করা হচ্ছে । এভাবে যেন দোয়া চাওয়ার পদ্ধতি শিক্ষা দেয়া হচ্ছে । অর্থাৎ দোয়া চাইতে হলে ভদ্র ও শালীন পদ্ধতিতে দোয়া চাইতে হবে । কারো সামনে গিয়ে মুখ খুলেই প্রথমে নিজের প্রয়োজনটা পেশ করে দেয়া কোন সৌজন্য ও ভব্যতার পরিচায়ক নয় । যার কাছে প্রার্থনা করা হচ্ছে প্রথমে তার গুণাবলী বর্ণনা করা এবং তার দান, অনুগ্রহ ও মর্যাদার স্বী কৃতি দেয়াই ভদ্রতার রীতি । আমরা দু'টি কারণে কারো প্রশংসা করে থাকি । প্রথমত তিনি প্রকৃতিগতভাবে কোন বিশেষ শ্রেষ্ঠত্ব ও গুণ-বৈশিষ্টের অধিকারী । তাঁর ঐ শ্রেষ্ঠত্ব ও গুণ –বৈশিষ্ট আমাদের ওপর কি প্রভাব ফেলে সেটা বড় কথা নয় । দ্বিতীয়ত তিনি আমাদের প্রতি অনুগ্রহকারী এবং আমরা তাঁর অনুগ্রহের স্বীকৃতির আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়েই তাঁর গুণাবলী বর্ণনা করি । মহান আল্লাহর প্রশংসা এই উভয় কারণে ও উভয় দিক দিয়েই করতে হয় । আমরা হামেসা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হব, এটি তাঁর অপরিসীম মর্যাদা ও আমাদের প্রতি তাঁর অশেষ অনুগ্রহের দাবী ।আর প্রশংসা আল্লাহর জন্য, কেবল এখানেই কথা শেষ নয় বরং সঠিকভাবে বলা যায়, "প্রশংসা একমাত্র আল্লাহরই" জন্য । একথাটি বলে একটি বিরাট সত্যের ওপর থেকে আবরণ উঠিয়ে নেয়া হয়েছে । আর এটি এমন একটি সত্য যার প্রথম আঘাতেই "সৃষ্টি পূজা'র মূলে কুঠারঘাত হয় । দুনিয়ায় যেখানে যে বস্তুর মধ্যে যে আকৃতিতেই কোন সৌন্দর্য, বৈশিষ্ট ও শ্রেষ্ঠত্ব বিরাজিত আছে আল্লাহর সত্তাই মূলত তার উৎস । কোন মানুষ ফেরেশতা, দেবতা, গ্রহ-নক্ষত্র তথা কোন সৃষ্টির নিজস্ব কোন গুণ-বৈশিষ্ট শ্রেষ্ঠত্ব নেই । বরং এসবই আল্লাহ প্রদত্ত। কাজেই যদি কেউ এ অধিকার দাবী করেন যে, আমরা তাঁর প্রশংসা কীর্তন করব, তাঁকে পূজা করব, তাঁর অনুগ্রহ স্বীকার করব ও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব এবং তাঁর খেদমত গার ও সেবক হব, তাহলে তিনি হবেন সেই শ্রেষ্ঠত্ব ও গুণ-বৈশেষ্টের স্রষ্টা ঐ শ্রেষ্ঠত্ব ও গুণ-বৈশিষ্টের অধিকারী মানব-সত্তা নয় । ৩ . 'রব' শব্দটিকে আরবী ভাষায় তিনটি অর্থে ব্যবহার করা হয় । এক, মালিক ও প্রভু । দুই, অভিভাবক, প্রতিপালনকারী , রক্ষণাবেক্ষণকারী ও সংরক্ষণকারী । তিন, সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, শাসনকর্তা পরিচালক ও সংগঠক ।
الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِ
যিনি পরম দয়ালু ও করুণাময়
এই আয়াতের মর্মার্থ দুইভাবে বর্ণণনা করা যায়। ১।যারা আল্লাহর দেওয়া জীবন ব্যাবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় আজীবন সংগ্রাম করে যাচ্ছে’ দ্বীনের উপর অবিচল আছে হাজার কষ্টের ভিতরেও বাতিলের সাথে আপোষ ক রে নাই দুনিয়াতে এই সমস্ত জাতের মানুষকে আল্লাহ তার প্রকৃতির সুযোগ সুবিধা যেভাবে উপভোগ করাচ্ছেন পক্ষান্তরে ইমানদারদের দুশমনদের ও আল্লাহ দুনিয়াতে প্রকৃতির সুযোগ একইভাবে ভোগ করার সুবিধা দিয়েছেন।মুসলমান ইমানদার সূর্য্যের আলো,নদীর মাছ’ জমির ফসল’বেশি পাবে আর কাফেরা কম পাবে এমনটি নয়।এই কারণে আল্লাহ সকল সৃষ্টিকুলের জন্য “রহমান”বা দাতা।কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে দতার সাথে তিনি দয়ালু হয়ে যান যা শুধু ইমানদারদের জন্য প্রযোয্য এই ভাগে কাফের মুশরেক নাস্তিক মুরতাদদের কোন অংশ নেই।তবে আল্লাহর এই “রহিম” গুনাবলীর শতভাগের একভাগ আল্লাহ দুনিয়াতে নবী রাসূল মুমেন মুজাহীদদের জন্য রেখেছেন যার বদৌলতে নবী রাসূলদের ও ইমানদারদের বিভিন্ন পরীক্ষার সময় দয়াকরে সাহায্য করেন মুমেনদের রিযিকে বরকত দেন হালালে মনে প্রশান্তি দেন বাকী নিরানব্বই ভাগ দয়া আখেরাতের ময়দানে নবী রাসূল ও মোমেনদের উপর প্রদর্শন করে তাদেরকে জান্নাত প্রদান করবেন। ২। মানুষের দৃষ্টিতে কোন জিনিস খুব বেশী বলে প্র তীয়মান হলে সেজন্য সে এমন শব্দ ব্যবহার করে যার মাধ্যমে আধিক্যের প্রকাশ ঘটে । আর একটি আধিক্যবোধক শব্দ বলা র পর যখন সে অনুভব করে যে ঐ শব্দটির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট জিনিসটির আধিক্যের প্রকাশ করা সন্ভব হয়নি তখন সে সেই একই অর্থে আর একটি শব্দ ব্যবহার করে । এভাবে শব্দটির অন্তরনিহিত গুণের আধিক্য প্রকাশের ব্যাপারে যে কমতি রয়েছে বলে সে মনে করছে তা পূরণ করে। আল্লাহর প্রশংসায় 'রহমান' শব্দের পরে আবার 'রহীম' বলার মধ্যেও এই একই নিগূঢ় ত ত্ত্ব নিহিত রয়েছে । আরবী ভাষায় 'রহমান' একটি বিপুল আধিক্যবোধক শব্দ । কিন্তু সৃষ্টির প্রতি আল্লাহর রহমত ও মেহের বানী এত বেশী ও ব্যাপক এবং এত সীমাসংখ্যাহীন যে, তা বয়ান করার জন্য সবচেয়ে বেশী ও বড় আধিক্যবোধক শব্দ ব্যব হার করার পরও মন ভরে না । তাই তার আধিক্য প্রকাশের হক আদায় করার জন্য আবার 'রহীম' শব্দটিও বলা হয়েছে । এর দৃষ্টান্ত এভাবে দেয়া যেতে পারে, যেমন আমরা কোন ব্যক্তির দানশীলতার গুণ বর্ণনা করার জন্য 'দাতা' বলার পরও যখ ন অতৃপ্তি অনুভব করি তখন এর সাথে 'দানবীর' শব্দটিও লাগিয়ে দেই। রঙের প্রশংসায় 'সাদা' শব্দটি বলার পর আবার 'দু ধের মতো সাদা' বলে থাকি ।
مٰلِکِ یَوۡمِ الدِّیۡ ৩) প্রতিদান দিবসের মালিক ৷ আমরা বাংলা ভাষাভাষি মানুষ “মালিক” বলতে আমাদের পরিভাষায় যতটুকু বুঝি যে, যেদিন মানবজাতির পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমস্ত বংশধরদেরকে একত্র করে তাদের জীবনের সমগ্র কর্মকান্ডের হিসেব নেয়া হবে । প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার পূর্ন কর্মফল দেয়া হবে । তিনি সেই দিনের এ কচ্ছত্র অধিপতি , আল্লাহর প্রশংসায় রহমান ও রহীম শব্দ ব্যবহার করার পর তিনি প্রতিদান দিবসের মালিক একথা বলায় এখান থেকে এ অর্থও প্রকাশিত হয় যে, তিনি নিছক দয়ালু ও করুণাময় নন বরং এই সংগে তিনি ন্যায় বিচারকও । আবার তিনি এমন ন্যায় বিচারক যিনি হবেন শেষ বিচার ও রায় শুনানীর দিনে পরিপূর্ণ ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের মালিক সেদিন তিনি শাস্তি প্রদান করলে কেউ তাতে বাধা দিতে পারবে না । এবং পুরস্কার দিলেও কেউ ঠেকাতে পারবে না । কাজেই তিনি আমাদের প্রতিপালন করেন ও আমাদের প্রতি করুণা করেন এ জন্য যে আমরা তাঁকে ভালোবাসি শুধু এতটুকুই নয় বরং তিনি ইনসাফ ও ন্যায় বিচার করেন এ জন্য আমরা তাঁকে ভয়ও করি এবংএই অনুভূতিও রাখি যে , আমাদের পরিণামের ভালো মন্দ পুরোপুরি তাঁরই হাতে ন্যস্ত ।
اِ یَّاکَ نَعۡبُدُ وَ اِیَّاکَ نَسۡتَعِیۡنُ ؕ﴿۴﴾ঃ
আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদাত করি এবং একমাত্র তোমারই কাছে সাহায্য চাই
মানুষের স্বভাবজাত প্রক্রিয়া যে সে যদি কারো কাছে কোন কিছু পাওয়ার আশা করতে যায় তাহলে আগে তার কিছু প্রশংসা করে নেই।সে র একটা এমন একটি বিষয়ের জন্য আল্লাহ তায়ালার নিকট দরখাস্তে কাকুতি মিনতি করছে যেটি আল্লাহ পাকের কা ছে ছাড়া আর কারো কাছে নেই।ইবাদত শব্দটিও আরবী ভাষায় তিনটি অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে । (১)পূজা ও উপাসনা করা , (২)আনুগত্য ও হুকুম মেনে চলা এবং (৩) বন্দেগী ও দাসত্ব করা । এখানে একই সাথে এই তিনটি অর্থই প্রকাশিত হয়েছে । অর্থাৎ আমরা তোমার পূজা-উপাসনা করি , তোমার আনুগত্য করি এবং তোমার বন্দেগী ও দাসত্বও করি । আর আমরা তোমার সাথে এ সম্পর্কগুলো রাখি কেবল এখানেই কথা শেষ নয় বরং এ সম্পর্কগুলো আমরা একমাত্র তোমারই সাথে রাখি । এই তিনটি অর্থের মধ্যে কোন একটি অর্থেও অন্য কেউ আমাদের মাবুদ নয় ।অর্থাৎ তোমার সাথে আমাদের সম্পর্ক কে বল ইবাদাতের নয় বরং আমাদের সাহায্য প্রার্থনার সম্পর্কও একমাত্র তোমারই সাথে রয়েছে । আমরা জানি তুমিই সমগ্র বিশ্ব- জাহানের রব । সমস্ত শক্তি তোমারই হাতে কেন্দ্রভূত । তুমি একাই যাবতীয় নিয়ামত ও অনুগ্রহের অধিকারী । তাই আমাদের অভাব ও প্রয়োজন পূরণের জন্য আমরা একমাত্র তোমারই দুয়ারে ধর্ণা দেই । তোমারই সামনে নিজেদের সুপর্দ করে দেই এবং তোমারই সাহায্যের ওপর নির্ভর করি । এ জন্য আমাদের এই আবেদন নিয়ে আমরা তোমার দুয়ারে হাজির হয়েছি ।
اهدِنَــــا الصِّرَاطَ المُستَقِيمَ
আমাদের সহজ সরল পথ প্রদর্শন করো।বা আমাদেরকে হেদায়েতের পথ প্রদর্শন করো।
তাফসীরঃ
আল্লাহ পাকের অনেক গুনগান করার পর এখন আল্লাহর নিকট তার বান্দার চাওয়া পাওয়া,প্রার্থনার কথা বলা হচ্ছে।আল্লাহ তার বান্দাকে শিখিয়ে দিচ্ছেন ও বান্দা তুমি প্রথমে আমার নিকট সহজ সরল একটা রাস্তা পাওয়ার জন্য আবেদন করো আমি যখন তোমাকে সহজ সরল রাস্তায় উঠিয়ে দিব তখন দুনিয়ার বাকী চাওয়া পাওয়া আমার কাছে চাইলেই তোমার জন্য যেটা কল্যান সেটা তোমাকে দিয়ে দেব। গোলক ধাঁধাঁর এই পৃথিবীতে মত আর পথের কোন অভাব নেই।মনের অজান্তেই মানব যেন একেকজন নিজেকে অনেক ক্ষমতার মালিক মনে করে সাধারণ মানুষকে তার অনুসারী বানিয়ে জাহান্নামের পথের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।এই অবস্থায় একজন সুস্থ মানুষ তার রবের নিকট কোন পথের জন্য আবেদন করতে পারে?তার জীবনের প্রত্যেকটি শাখা প্রশাখায় এবং প্রত্যেকটি বিভাগে, চিন্তা, কর্ম ও আচরণের এমন বিধি-ব্যবস্থা আমাদের শেখাও , যা হবে একেবারেই নির্ভুল , যেখানে ভুল দেখা , ভুল কাজ করা ও অশুভ পরিণামের আশংকা নেই, যে পথে চলে আমরা সাফল্য ও সৌভাগ্যের অধিকারী হতে পারি । কুরআন অধ্যয়নের প্রাক্কালে বান্দা তার প্রভু , মালিক, আল্লাহর কাছে এই আবেদনটি পেশ করে । বান্দা আর্জি পেশ করে , হে আল্লাহ! তুমি আমাদের পথ দেখাও । কল্পিত দর্শনের গোলকধাঁধার মধ্য থেকে যথার্থ সত্যকে উন্মুক্ত করে আমাদের সামনে তুলে ধর । বিভিন্ন নৈতিক চিন্তা-দর্শনের মধ্য থেকে যথার্থ ও নির্ভুল নৈতিক চিন্তা-দর্শন আমাদের সামনে উপস্থাপিত কর । জীবনের অসংখ্য পথের মধ্য থেকে চিন্তা ও কর্মের , সরল ও সুস্পষ্ট রাজপথটি আমাদের দেখাও ।আমাদের মুসলমানেরা প্রতিদিন এই সমস্ত আয়াতগুলো নামজের ভিতর বহুবার পড়ে কিন্তু নিজের ভিতর এই আয়াতের কোন আচর হচ্ছে কিনা একটা বার ও বিবেকের কড়া নেড়ে দেখছেনা। একজন মুসলমান তার নামাজের ভিতর আল্লাহর নিকট হেদায়েতের পথ কামনা করার পর সে যদি মানব রচিত কোন জীবন ব্যবস্থাকে মেনে নেই তাহলে সে আল্লাহর সাথে মোনাফেকী করলো।
صِرَاطَ الَّذِينَ أَنعَمتَ عَلَيهِمْ غَيرِ المَغضُوبِ عَلَيهِمْ وَلاَ الضَّالِّينَ (7 তাদের পথ যাদের প্রতি তুমি অনুগ্রহ করেছ, ।যাদের ওপর গযব পড়েনি এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়নি।
তাফসীর :
এখানে পূর্বেকার সফলকাম নবী রাসুল এবং আল্লাহর প্রিয় পাত্রদের উদাহরণ এর কথা বলে আল্লাহ তার বান্দাদের সঠিক পথপ্রাপ্তির পদ্ধতিটা জানিয়ে দিচ্ছেন। মহান আল্লাহর কাছ থেকে আমরা যে সোজা পথটির জ্ঞান লাভ করতে চাচ্ছি এটা হচ্ছে তার পরিচয়। অর্থাৎ এমন পথ যার ওপর সবসময় তোমার প্রিয়জনেরা চলেছেন। সেই নির্ভুল রাজপথটি অতি প্রাচীনকাল থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত যে ব্যক্তি ও যে দলটিই তার ওপর চলেছে সে তোমার অনুগ্রহ লাভ করেছে এবং তোমার দানে তার জীবন পাত্র পরিপূর্ণ হয়েছে। অর্থাৎ ‘অনুগ্রহ’ লাভকারী হিসাবে এমন সব লোককে চিহ্নিত করা হয়নি যারা আপাতদৃষ্টিতে সাময়িকভাবে তোমার পার্থিব অনুগ্রহ লাভ করে থাকে ঠিকই কিন্তু আসলে তারা হয় তোমার গযব ও শাস্তির অধিকারী এবং এভাবে তারা নিজেদের সাফল্য ও সৌভাগ্যের পথ হারিয়ে ফেলে। এ নেতিবাচক ব্যাখ্যায় একথা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ‘অনুগ্রহ’ বলতে যথার্থ ও স্থায়ী অনুগ্রহ বুঝানো হয়েছে, যা আসলে সঠিক পথে চলা ও আল্লাহর সন্তোষ লাভের ফলে অর্জিত হয়। এমন কোন সাময়িক ও লোক দেখানো অনুগ্রহ নয়, যা ইতিপূর্বে ফেরাউন, নমরূদ ও কারূনরা লাভ করেছিল এবং আজও আমাদের চোখের সামনে বড় বড় যালেম, দুস্কৃতিকারী ও পথভ্রষ্টরা যেগুলো লাভ করে চলেছে।

সূরা আল বাকারা

(মদীনায় অবতীর্ণ),
নামকরণ
বাকারাহ মানে গাভী। এ সূরার এক জায়গায় গাভীর উল্লেখ থাকার কারণে এর এই নামকরণ করা হয়েছে। কুরআন মজীদের প্রত্যেকটি সূরায় এত ব্যাপক বিষয়ের আলোচনা করা হয়েছে, যার ফলে বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে তাদের জন্য কোন পরিপূর্ণ ও সার্বিক অর্থবোধক শিরোনাম উদ্ভাবন করা সম্ভব নয়। শব্দ সম্ভারের দিক দিয়ে আরবী ভাষা অত্যন্ত সমৃদ্ধ হলেও মূলত এটি তো মানুষেরই ভাষা। আর মানুষের মধ্যে প্রচলিত ভাষাগুলো খুব বেশী সংকীর্ণ ও সীমিত পরিসর সম্পন্ন। সেখানে এই ধরনের ব্যাপক বিষয়বস্তুর জন্য পরিপূর্ণ অর্থব্যাঞ্জক শিরোনাম তৈরি করার মতো শব্দ বা বাক্যের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এজন্য নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহান আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী কুরআনের অধিকাংশ সূরার জন্য শিরোনামের পরিবর্তে নিছক আলামত ভিত্তিক নাম রেখেছেন। এই সূরার নামকরণ আল বাকারাহ করার অর্থ কেবল এতটুকু যে, এখানে গাভীর কথা বলা হয়েছে।
নাযিল হওয়ার সময়-কাল :।
এ সূরার বেশীর ভাগ মদীনায় হিজরতের পর মাদানী জীবনের একেবারে প্রথম যুগে নাযিল হয় । আর এর কম অংশ পরে নাযিল হয়। বিষয়স্তুর সাথে সামঞ্জস্য ও সাদৃশ্যের কারণে এগুলোকে প্রথমোক্ত অংশের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে। এমনকি সুদ নিষিদ্ধকরণ সম্পর্কিত যে আয়াতগুলো নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের একেবারে শেষ পর্যায়ে নাযিল হয় সেগুলোও এখানে সংযোজিত করা হয়েছে। যে আয়াতগুলো দিয়ে সূরাটি শেষ করা হয়েছে সেগুলো হিজরতের আগে মক্কায় নাযিল হয়। কিন্তু বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্যের কারণে সেগুলোকেও এ সূরার সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে।
প্রেক্ষাপট :
এ সূরাটি বুঝতে হলে প্রথমে এর ঐতিহাসিক পটভূমি ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে। :
(১) হিজরতের আগে ইসলামের দাওয়াতের কাজ চলছিল কেবল মক্কায় । এ সময় পর্যন্ত সম্বোধন করা হচ্ছিল কেবলমাত্র আরবের মুশরিকদেরকে। তাদের কাছে ইসলামের বাণী ছিল সম্পূর্ণ নতুন ও অপরিচিত। এখন হিজরতের পরে ইহুদিরা সামনে এসে গেল। তাদের জনবসতিগুলো ছিল মদীনার সাথে একেবারে লাগানো। তারা তাওহীদ, রিসালাত, অহী, আখেরাত ও ফেরেশতার স্বীকৃতি দিত। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের নবী মূসা আলাইহিস সালামের ওপর যে শরিয়াতী বিধান নাযিল হয়েছিল তারও স্বীকৃতি দিত। নীতিগতভাবে তারাও সেই দ্বীন ইসলামের অনুসারী ছিল যার শিক্ষা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দিয়ে চলছিলেন। কিন্তু বহু শতাব্দী কালের ক্রমাগত পতন ও অবনতির ফলে তারা আসল দ্বীন থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিল। ১ তাদের আকীদা-বিশ্বাসের মধ্যে বহু অনৈসলামী বিষয়ের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। তাওরাতে এর কোন ভিত্তি ছিল না। তাদের কর্মজীবনে এমন অসংখ্য রীতি-পদ্ধতির প্রচলন ঘটেছিল যথার্থ দ্বীনের সাথে যেগুলোর কোন সম্পর্ক ছিল না। তাওরাতের মূল বিষয়বস্তুর সাথেও এগুলোর কোন সামঞ্জস্য ছিল না। আল্লাহর কালাম তাওরাতের মধ্যে তারা মানুষের কথা মিশিয়ে দিয়েছিল। শাব্দিক বা অর্থগত দিক দিয়ে আল্লাহর কালাম যতটুকু পরিমাণ সংরক্ষিত ছিল তাকেও তারা নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিকৃত করে দিয়েছিল। দ্বীনের যথার্থ প্রাণবস্তু তাদের মধ্য থেকে অন্তরহিত হয়ে গিয়েছিল । লোক দেখানো ধার্মিকতার নিছক একটা নিস্প্রাণ খোলসকে তারা বুকের সাথে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল। তাদের উলামা, মাশায়েখ, জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও জনগণ –-সবার আকীদা-বিশ্বাস এবং নৈতিক ও বাস্তব কর্মজীবন বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। নিজেদের এই বিকৃতির প্রতি তাদের আসক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল, যার ফলে কোনো প্রকার সংস্কার-সংশোধন গ্রহণের তারা বিরোধী হয়ে উঠেছিল। যখনই কোন আল্লাহর বান্দা তাদেরকে আল্লাহর দ্বীনের সরল-সোজা পথের সন্ধান দিতে আসতেন, তখনই তারা তাঁকে নিজেদের সবচেয়ে বড় দুশমন মনে করে সম্ভাব্য সকল উপায়ে তার সংশোধন প্রচেষ্টা ব্যর্থ করার জন্য উঠে পড়ে লাগতো। শত শত বছর ধরে ক্রমাগতভাবে এই একই ধারার পুনরাবৃত্তি হয়ে চলছিল। এরা ছিল আসলে বিকৃত মুসলিম। দ্বীনের মধ্যে বিকৃতি, দ্বীন বহির্ভূত বিষয়গুলোর দ্বীনের মধ্যে অনুপ্রবেশ, ছোটখাটো বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি, দলাদলি, বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বাদ দিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুত্বহীন বিষয় নিয়ে মাতামাতি, আল্লাহকে ভুলে যাওয়া ও পার্থিব লোভ-লালসায় আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়ে যাওয়ার কারণে তারা পতনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। এমন কি তারা নিজেদের আসল ‘মুসলিম’ নামও ভুলে গিয়েছিল। নিছক ‘ইহুদি’ নামের মধ্যেই তারা নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। আল্লাহর দ্বীনকে তারা কেবল ইসরাঈল বংশজাতদের পিতৃসূত্রে প্রাপ্ত উত্তরাধিকারে পরিণত করেছিল। কাজেই নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় পৌছার পর ইহুদিদেরকে আসল দ্বীনের দিকে আহবান করার জন্য আল্লাহ তাঁকে নির্দেশ দিলেন। সূরা বাকারার ১৫ ও ১৬ রুকূ’ এ দাওয়াত সম্বলিত। এ দু’রুকূ’তে যেভাবে ইহুদিদের ইতিহাস এবং তাদের নৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থার সমালোচনা করা হয়েছে এবং যেভাবে তাদের বিকৃত ধর্ম ও নৈতিকতার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের মোকাবিলায় যথার্থ দ্বীনের মূলনীতিগুলো পাশাপাশি উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে আনুষ্ঠানিক ধার্মিকতার মোকাবিলায় যথার্থ ধার্মিকতা কাকে বলে, সত্য ধর্মের মূলনীতিগুলো কি এবং আল্লাহর দৃষ্টিতে কোন্‌ কোন্‌ জিনিস যথার্থ গুরুত্বের অধিকারী তা দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ১. এ সময়ের প্রায় ১৯শ’বছর আগে হযরত মূসার (আ) যুগ অতীত হয়েছিল। ইসরাঈলী ইতিহাসের হিসেব মতে হযরত মূসা (আ) খৃঃ পূঃ ১২৭২ অব্দে ইন্তিকাল করেন। অন্যদিকে নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৬১০ খৃস্টাব্দে নবুয়াত লাভ করেন।
(২) মদীনায় পৌছার পর ইসলামী দাওয়াত একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছিল। মক্কায় তো কেবল দ্বীনের মূলনীতিগুলোর প্রচার এবং দ্বীনের দাওয়াত গ্রহণকারীদের নৈতিক প্রশিক্ষণ দানের মধ্যেই ইসলামী দাওয়াতের কাজ সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু হিজরতের পর যখন আরবের বিভিন্ন গোত্রের লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করে চতুর্দিক থেকে মদীনায় এসে জমায়েত হতে থাকলো এবং আনসারদের সহায়তায় একটি ছোট্ট ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্‌ গড়ে উঠলো, তখন মহান আল্লাহ সমাজ, সংস্কৃতি, লোকাচার, অর্থনীতি ও আইন সম্পর্কিত মৌলিক বিধান দিতে থাকলেন এবং ইসলামী মূলনীতির ভিত্তিতে এ নতুন জীবন ব্যবস্থাটি কিভাবে গড়ে তুলতে হবে তারও নির্দেশ দিতে থাকলেন। এ সূরার শেষ ২৩টি রুকু’তে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এ নির্দেশ ও বিধানগুলো বয়ান করা হয়েছে। এর অধিকাংশ শুরুতেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং কিছু পাঠানো হয়েছিল পরবর্তী পর্যায়ে প্রয়োজন অনুযায়ী বিক্ষিপ্তভাবে।
(৩) হিজরতের পর ইসলাম ও কুফরের সংঘাতও একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছিল। হিজরতের আগে ইসলামের দাওয়াত কুফরের ঘরের মধ্যেই দেয়া হচ্ছিল। তখন বিভিন্ন গোত্রের যেসব লোক ইসলাম গ্রহণ করতো, তারা নিজেদের জায়গায় দ্বীনের প্রচার করতো। এর জবাবে তাদের নির্যাতনের শিকার হতে হতো। কিন্তু হিজরতের পরে এ বিক্ষিপ্ত মুসলমানরা মদীনায় একত্র হয়ে একটি ছোট্ট ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করার পর অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে গেলো। তখন একদিকে ছিল একটি ছোট জনপদ এবং অন্যদিকে সমগ্র আরব ভূখন্ড তাকে ধ্বংস করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। এখন এ ছোট্ট জামায়াতটির কেবল সাফল্যই নয় বরং তার অস্তিত্ব ও জীবনই নির্ভর করছিল পাঁচটি জিনিসের ওপর। এক, পূর্ণ শক্তিতে ও পরিপূর্ণ উৎসাহ-উদ্দীপনা সহকারে নিজের মতবাদের প্রচার করে সর্বাধিক সংখ্যক লোককে নিজের চিন্তা ও আকীদা-বিশ্বাসের অনুসারী করার চেষ্টা করা। দুই, বিরোধীদের বাতিল ও ভ্রান্ত পথের অনুসারী বিষয়টি তাকে এমনভাবে প্রমাণ করতে হবে যেন কোন বুদ্ধি-বিবেকবান ব্যক্তির মনে এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্রও সংশয় না থাকে। তিন, গৃহহারা ও সারা দেশের মানুষের শত্রুতা ও বিরোধিতার সম্মুখীন হবার কারণে অভাব-অনটন, অনাহার-অর্ধাহার এবং সার্বক্ষণিক অশান্তি ও নিরাপত্তাহীনতায় সে ভুগছিল। চতুর্দিক থেকে বিপদ তাকে ঘিরে নিয়েছিল। এ অবস্থায় যেন সে ভীত-সন্ত্রস্ত না হয়ে পড়ে। পূর্ণ ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা সহকারে যেন অবস্থার মোকাবিলা করে এবং নিজের সংকল্পের মধ্যে সামান্যতম দ্বিধা সৃষ্টির সুযোগ না দেয়। চার, তার দাওয়াতকে ব্যর্থকাম করার জন্য যে কোন দিক থেকে যে কোন সশস্ত্র আক্রমণ আসবে, পূর্ণ সাহসিকতার সাথে তার মোকাবিলা করার জন্য তাকে প্রস্তুত হতে হবে। বিরোধী পক্ষের সংখ্যা ও তাদের শক্তির আধিক্যের পরোয়া করা চলবে না। পাঁচ, তার মধ্যে এমন সুদৃঢ় হিম্মত সৃষ্টি করতে হবে, যার ফলে আরবের লোকেরা ইসলাম যে নতুন ব্যবস্থা কায়েম করতে চায় তাকে আপসে গ্রহণ করতে না চাইলে বল প্রয়োগে জাহেলিয়াতের বাতিল ব্যবস্থাকে মিটিয়ে দিতে সে একটুও ইতস্তত করবে না। এ সূরায় আল্লাহ এ পাঁচটি বিষয়ের প্রাথমিক নির্দেশনা দিয়েছেন।
(৪) ইসলামী দাওয়াতের এ পর্যায়ে একটি নতুন গোষ্ঠীও আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করেছিল। এটি ছিল মুনাফিক গোষ্ঠী। নবী করীমের (সা.) মক্কায় অবস্থান কালের শেষের দিকেই মুনাফিকীর প্রাথমিক আলামতগুলো সুস্পষ্ট হতে শুরু হয়েছিল। তবুও সেখানে কেবল এমন ধরনের মুনাফিক পাওয়া যেতো যারা ইসলামের সত্যতা স্বীকার করতো এবং নিজেদের ঈমানের ঘোষণাও দিতো। কিন্তু এ সত্যের খাতিরে নিজেদের স্বার্থ বিকিয়ে দিতে, নিজেদের পার্থিব সম্পর্কচ্ছেদ করতে এবং এ সত্য মতবাদটি গ্রহণ করার সাথে সাথেই যে সমস্ত বিপদ-আপদ, যন্ত্রণা-লাঞ্ছনা ও নিপীড়ন–নির্যাতন নেমে আসতে থাকতো তা মাথা পেতে নিতে তারা প্রস্তুত ছিল না। মদীনায় আসার পর এ ধরনের মুনাফিকদের ছাড়াও আরো কয়েক ধরনের মুনাফিক ইসলামী দলে দেখা যেতে লাগলো। মুনাফিকদের একটি গোষ্ঠী ছিল ইসলামকে চূড়ান্তভাবে অস্বীকারকারী। তারা নিছক ফিত্‌না সৃষ্টি করার জন্য মুসলমানদের দলে প্রবেশ করতো।
মুনাফিকদের দ্বিতীয় গোষ্ঠীটির অবস্থা ছিল এই যে, চতুর্দিক থেকে মুসলিম কর্তৃত্ব ও প্রশাসন দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে যাবার কারণে তারা নিজেদের স্বার্থ-সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে একদিকে নিজেদেরকে মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত করতো এবং অন্যদিকে ইসলাম বিরোধীদের সাথেও সম্পর্ক রাখতো। এভাবে তারা উভয় দিকের লাভের হিস্‌সা ঝুলিতে রাখতো এবং উভয় দিকের বিপদের ঝাপ্‌টা থেকেও সংরক্ষিত থাকতো।
তৃতীয় গোষ্ঠীতে এমন ধরনের মুনাফিকদের সমাবেশ ঘটেছিল যারা ছিল ইসলাম ও জাহেলিয়াতের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে দোদুল্যমান। ইসলামের সত্যতার ব্যাপারে তারা পূর্ণ নিশ্চিন্ত ছিল না। কিন্তু যেহেতু তাদের গোত্রের বা বংশের বেশির ভাগ লোক মুসলমান হয়ে গিয়েছিল, তাই তারাও মুসলমান হয়ে গিয়েছিল। মুনাফিকদের চতুর্থ গোষ্ঠীটিতে এমন সব লোকের সমাবেশ ঘটেছিল যারা ইসলামকে সত্য বলে স্বীকার করে নিয়েছিল, কিন্তু জাহেলিয়াতের আচার–আচরণ, কুসংস্কার ও বিশ্বাসগুলো ত্যাগ করতে, নৈতিক বাধ্যবাধকতার শৃঙ্খল গলায় পরে নিতে এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যের বোঝা বহন করতে তাদের মন চাইতো না। সূরা বাকারাহ নাযিলের সময় সবেমাত্র এসব বিভিন্ন ধরনের মুনাফিক গোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ শুরু হয়েছিল। তাই মহান আল্লাহ এখানে তাদের প্রতি সংক্ষিপ্ত ইঙ্গিত করেছেন মাত্র। পরবর্তীকালে তাদের চরিত্র ও গতি-প্রকৃতি যতই সুস্পষ্ট হতে থাকলো, ততই বিস্তারিতভাবে আল্লাহ তা’আলা বিভিন্ন মুনাফিক গোষ্ঠীর প্রকৃতি অনুযায়ী পরবর্তী সূরাগুলোয় তাদের সম্পর্কে আলাদা আলাদাভাবে নির্দেশ দিয়েছেন
سْمِ اللّهِ الرَّحْمـَنِ الرَّحِيمِ শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।
الم আলিফ লাম মিম,( যার অর্থ একমাত্র আল্লাহ তায়ালা জানেন)
তাফসীর
: এ বিচ্ছিন্ন হরফ গুলো আল্লাহ পাকের দেয়া চ্যালেঞ্জ যা তার বান্দার প্রতি নিক্ষেপ করা হয়েছে,আল্লাহ যেন বুঝাতে চাচ্ছেন যে তোমরা যেমন অক্ষর দিয়ে শব্দ,আর শব্দ দিয়ে বাক্য তৈরি করো তেমনিভাবে আমি এ বিচ্ছিন্ন হরফ গুলো দিয়ে আমার কোরআনকে অলংকৃত করেছি। কুরআন মজীদের কোন কোন সূরার শুরুতে এগুলো দেখা যায়। কুরআন মজীদ নাযিলের যুগে সমকালীন আরবী সাহিত্যে এর ব্যবহার ছিল। বক্তার বক্তব্য প্রকাশের ক্ষেত্রে সাধারণত এর ব্যবহার প্রচলিত ছিল। বক্তা ও কবি উভয় গোষ্ঠীই এ পদ্ধতির আশ্রয় নিতেন। বর্তমানে জাহেলী যুগের কবিতার যেসব নমুনা সংরক্ষিত আছে তার মধ্যেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। সাধারণভাবে ব্যবহারের কারণে এ বিচ্ছিন্ন হরফগুলো কোন ধাঁধা হিসেবে চিহ্নিত হয়নি। এগুলো এমন ছিল না যে, কেবল বক্তাই এগুলোর অর্থ বুঝতো বরং শ্রোতারাও এর অর্থ বুঝতে পারতো। এ কারণে দেখা যায়, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমকালীন বিরোধীদের একজনও এর বিরুদ্ধে আপত্তি জানায়নি। তাদের একজনও একথা বলেনি যে, বিভিন্ন সূরার শুরুতে আপনি যে কাটা কাটা হরফগুলো বলে যাচ্ছেন এগুলো কি? এ কারণেই সাহাবায়ে কেরাম ও নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এগুলোর অর্থ জানতে চেয়েছেন এ মর্মে কোন হাদীসও উদ্ধৃত হতে দেখা যায়নি। পরবর্তীকালে আরবী ভাষায় এ বর্ণনা পদ্ধতি পরিত্যক্ত হতে চলেছে। ফলে কুরআন ব্যাখ্যাকারীদের জন্য এগুলোর অর্থ নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে একথা সুস্পষ্ট যে, কুরআন থেকে হিদায়াত লাভ করা এ শব্দগুলোর অর্থ বুঝার ওপর নির্ভরশীল নয়। অথবা এ হরফগুলোর মানে না বুঝলে কোন ব্যক্তির সরল সোজা পথ লাভের মধ্যে গলদ থেকে যাবে, এমন কোন কথাও নেই। কাজেই একজন সাধারণ পাঠকের জন্য এর অর্থ অনুসন্ধানে ব্যাকুল হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।
ذَلِكَ الْكِتَابُ لاَ رَيْبَ فِيهِ هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ (2 এ সেই কিতাব যাতে কোনই সন্দেহ নেই। পথ প্রদর্শনকারী পরহেযগারদের জন্য,
তাফসীর
: অতীতের আসমানী কিতাব সমুহ মানুষের হাতে আসার পর মানুষ নিজেদের সুবিধা মতো তার পরিবর্তন পরিবর্ধন করেছে যা তখনকার দিনে সবাই জানতো।কিন্ত আল্লাহ এই কোরআন অবতীর্ণ করার সাথে সাথে মানুষকে বর্তমান ও ভবিষ্যত এর নির্দেশনা দিচ্ছেন যে এটা এমন একটি কিতাব যার ভিতরে কোন সন্দেহতো নে ই ই অতীতের কিতাবগুলোর মত পরিবর্তন পরিবর্ধন করে উম্মতের মাঝে চালিয়ে দিতেও সফল হবেনা।আল্লাহর দুশমনরা অনেক চেষ্টা করেছে কিন্ত পারে নাই
তাছাড়া এই আয়াতের আরো একটা সরল অর্থ এভাবে করা যায় “নিঃসন্দেহে এটা আল্লাহর কিতাব।” কিন্তু এর একটা অর্থ এও হতে পারে যে, এটা এমন একটা কিতাব যাতে সন্দেহের কোন লেশ নেই। দুনিয়ায় যতগুলো গ্রন্থে অতি প্রাকৃত এবং মানুষের বুদ্ধি-জ্ঞান বহির্ভূত বিষয়াবলী নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে সেগুলো সবই কল্পনা, ধারণা ও আন্দাজ–অনুমানের ভিত্তিতে লিখিত হয়েছে। তাই এ গ্রন্থগুলোর লেখকরাও নিজেদের রচনাবলীর নির্ভুলতা সম্পর্কে যতই প্রত্যয় প্রকাশ করুক না কেন, তাদের নির্ভুলতা সন্দেহ মুক্ত হতে পারেনা। কিন্তু এ কুরআন মজীদ এমন একটি গ্রন্থ যা আগাগোড়া নির্ভুল সত্য জ্ঞানে সমৃদ্ধ। এর রচয়িতা হচ্ছেন এমন এক মহান সত্তা, যিনি সমস্ত তত্ত্ব ও সত্যের জ্ঞান রাখেন। কাজেই এর মধ্যে সন্দেহের কোন অবকাশই নেই। মানুষ নিজের অজ্ঞতার কারণে এর মধ্যে সন্দেহ পোষণ করলে সেটা অবশ্য সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কথা এবং সেজন্য এ কিতাব দায়ী নয়। অর্থাৎ এটি একেবারে একটি হিদায়াত ও পথ নির্দেশনার গ্রন্থ। কিন্তু এর থেকে লাভবান হতে চাইলে মানুষের মধ্যে কয়েকটি মৌলিক গুণ থাকতে হবে। এর মধ্যে সর্বপ্রথম যে গুণটির প্রয়োজন সেটি হচ্ছে, তাকে “মুত্তাকী”হতে হবে।এই গ্রন্থ আল্লাহ ভীরুদেরকে সঠিক পথের দিশা দান করে।
আয়াত নং :-3 الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلٰوةَ وَمِمَّا رَزَقْنٰهُمْ يُنفِقُونَ যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে, নামায কায়েম করে এবং যে রিযিক আমি তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে খরচ করে।
তাফসীর :
মুত্তাকীনদের কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা আল্লাহ এখানে তুলে ধরে বুঝাতে চাচ্ছেন যে, তোমরা যারা কোরআনের হেদায়েত লাভ করে নিজেদেরকে ইমানের বলে ধন্য করে পরকালীন জীবনে মুক্তি পেতে চাও তারা যেন তাদের জীবনে এই গুনাবলী সমুহ বাস্তবায়ন করে। কুরআন থেকে লাভবান হবার জন্য এটি হচ্ছে দ্বিতীয় শর্ত। ‘গায়েব’ বা অদৃশ্য বলতে এমন গভীর সত্যের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যা মানুষের ইন্দ্রিয়াতীত এবং কখনো সরাসরি সাধারণ মানুষের প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় ধরা পড়ে না। যেমন আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী, ফেরেশতা, অহী, জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদি। এ গভীর সত্যগুলোকে না দেখে মেনে নেয়া এবং নবী এগুলোর খবর দিয়েছেন বলে তাঁর খবরের সত্যতার প্রতি আস্থা রেখে এগুলোকে মেনে নেয়াই হচ্ছে ‘ঈমান বিল গায়েব’ বা অদৃশ্যে বিশ্বাস। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আয়াতের অর্থ হচ্ছে এই যে, যে ব্যক্তি অনুভব করা যায় না এমন সত্যগুলো মেনে নিতে প্রস্তুত হবে, একমাত্র সে-ই কুরআনের হিদায়াত ও পথ নির্দেশনা থেকে উপকৃত হতে পারবে। আর যে ব্যক্তি মেনে নেয়ার জন্য দেখার, ঘ্রাণ নেয়ার ও আস্বাদন করার শর্ত আরোপ করে এবং যে ব্যক্তি বলে, আমি এমন কোন জিনিস মেনে নিতে পারি না যা পরিমাণ করা ও ওজন করা যায় না—সে এ কিতাব থেকে হিদায়াত ও পথ নির্দেশনা লাভ করতে পারবে না।
এটি হচ্ছে তৃতীয় শর্ত। এর অর্থ হচ্ছে, যারা কেবল মেনে নিয়ে নীরবে বসে থাকবে তারা কুরআন থেকে উপকৃত হতে পারবে না। বরং মেনে নেয়ার পর সঙ্গে সঙ্গেই তার আনুগত্য করা ও তাকে কার্যকর করাই হচ্ছে এ থেকে উপকৃত হবার জন্য একান্ত অপরিহার্য প্রয়োজন। আর বাস্তব আনুগত্যের প্রধান ও স্থায়ী আলামত হচ্ছে নামায। ঈমান আনার পর কয়েক ঘণ্টা অতিবাহিত হতে না হতেই মুয়াযযিন নামাযের জন্য আহবান জানায় আর ঈমানের দাবীদার ব্যক্তি বাস্তবে আনুগত্য করতে প্রস্তুত কি না তার ফায়সালা তখনই হয়ে যায়। এ মুয়াযযিন আবার প্রতিদিন পাঁচ বার আহবান জানাতে থাকে। যখনই এ ব্যক্তি তার আহবানে সাড়া না দেয় তখনই প্রকাশ হয়ে পড়ে যে, ঈমানের দাবীদার ব্যক্তি এবার আনুগত্য থেকে বের হয়ে এসেছে। কাজেই নামায ত্যাগ করা আসলে আনুগত্য ত্যাগ করারই নামান্তর। বলা বাহুল্য কোন ব্যক্তি যখন কারোর নির্দেশ মেনে চলতে প্রস্তুত থাকে না তখন তাকে নির্দেশ দেয়া আর না দেয়া সমান।ইকামাতে সালাত বা নামায কায়েম করা একটি ব্যাপক ও পূর্ণ অর্থবোধক পরিভাষা একথাটি অবশ্যি জেনে রাখা প্রয়োজন। এর অর্থ কেবল নিয়মিত নামায পড়া নয় বরং সামষ্টিকভাবে নামাযের ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত করাও এর অর্থের অন্তর্ভুক্ত। যদি কোন লোকালয়ে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেক ব্যক্তি নিয়মিতভাবে নামায পড়ে থাকে কিন্তু জামায়াতের সাথে এ ফরযটি আদায় করার ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে সেখানে নামায কায়েম আছে, একথা বলা যাবে না। কুরআনের হিদায়াত লাভ করার জন্য এটি হচ্ছে চতুর্থ শর্ত। সংকীর্ণমনা ও অর্থলোলুপ না হয়ে মানুষকে হতে হবে আল্লাহ‌ ও বান্দার অধিকার আদায়কারী। তার সম্পদে আল্লাহ‌ ও বান্দার যে অধিকার স্বীকৃত হয়েছে, তাকে তা আদায় করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যে বিষয়ের ওপর সে ঈমান এনেছে তার জন্য অর্থনৈতিক ত্যাগ স্বীকার করার ব্যাপারে সে কোন রকম ইতস্তত করতে পারবে না।
আয়াত নং :-4
وَالَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِمَآ أُنزِلَ إِلَيْكَ وَمَآ أُنزِلَ مِن قَبْلِكَ وَبِالْءَاخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ আর যে কিতাব তোমাদের ওপর নাযিল করা হয়েছে (অর্থাৎ কুরআন) এবং তোমার আগে যেসব কিতাব নাযিল করা হয়েছিল সে সবগুলোর ওপর ঈমান আনে৭ আর আখেরাতের ওপর একীন রাখে।
তাফসীর :
এটি হচ্ছে পঞ্চম শর্ত। অর্থাৎ আল্লাহ‌ অহীর মাধ্যমে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর পূর্ববর্তী নবীগণের ওপর বিভিন্ন যুগে ও বিভিন্ন দেশে যেসব কিতাব নাযিল করেছিলেন সেগুলোকে সত্য বলে মেনে নিতে হবে। এ শর্তটির কারণে যারা আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য বিধান অবতরণের প্রয়োজনীয়তাকে আদতে স্বীকারই করে না অথবা প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করলেও এজন্য অহী ও নবুওয়াতের প্রয়োজন আছে বলে মনে করে না এবং এর পরিবর্তে নিজেদের মনগড়া মতবাদকে আল্লাহর বিধান বলে ঘোষণা করে অথবা আল্লাহর কিতাবের স্বীকৃতি দিলেও কেবলমাত্র সেই কিতাবটি বা কিতাবগুলোর ওপর ঈমান আনে যেগুলোকে তাদের বাপ-দাদারা মেনে আসছে আর এ উৎস থেকে উৎসারিত অন্যান্য বিধানগুলোকে অস্বীকার করে –তাদের সবার জন্য কুরআনের হিদায়াতের দুয়ার রুদ্ধ। এ ধরনের সমস্ত লোককে আলাদা করে দিয়ে কুরআন তার অনুগ্রহ একমাত্র তাদের ওপর বর্ষণ করে, যারা নিজেদেরকে আল্লাহর বিধানের মুখাপেক্ষী মনে করে এবং আল্লাহর এ বিধান আলাদা আলাদাভাবে প্রত্যেকটি মানুষের কাছে না এসে বরং নবীদের ও আল্লাহর কিতাবের মাধ্যমেই মানুষের কাছে আসে বলে স্বীকার করে আর এই সঙ্গে বংশ, গোত্র বা জাতি প্রীতিতে লিপ্ত হয় না বরং নির্ভেজাল সত্যের পূজারী হয়, সত্য যেখানে যে আকৃতিতে আবির্ভূত হোক না কেন তারা তার সামনে মস্তক অবনত করে দেয়।
এটি ষষ্ঠ ও সর্বশেষ শর্ত। আখেরাত একটি ব্যাপক ও পরিপূর্ণ অর্থবোধক শব্দ। আকীদা-বিশ্বাসের বিভিন্ন উপাদানের সমষ্টির ভিত্তিতে আখেরাতের ভাবধারা গড়ে উঠেছে যেমনঃ
একঃ এ দুনিয়ায় মানুষ কোন দায়িত্বহীন জীব নয়। বরং নিজের সমস্ত কাজের জন্য তাকে আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করতে হবে।
দুইঃ দুনিয়ার বর্তমান ব্যবস্থা চিরন্তন নয়। এক সময় এর মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে এবং সে সময়টা একমাত্র আল্লাহই জানেন।
তিনঃ এ দুনিয়া শেষ হবার পর আল্লাহ‌ আর একটি দুনিয়া তৈরি করবেন। সৃষ্টির আদি থেকে নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে যত মানুষের জন্ম হয়েছে সবাইকে সেখানে একই সঙ্গে পুনর্বার সৃষ্টি করবেন। সবাইকে একত্র করে তাদের কর্মকাণ্ডের হিসেব নেবেন। সবাইকে তার কাজের পূর্ণ প্রতিদান দেবেন।
চারঃ আল্লাহর এ সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে সৎলোকেরা জান্নাতে স্থান পাবে এবং অসৎলোকদেরকে নিক্ষেপ করা হবে জাহান্নামে।
পাঁচঃ বর্তমান জীবনের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও অসমৃদ্ধি, সাফল্য ও ব্যর্থতার আসল মানদণ্ড নয়। বরং আল্লাহর শেষ বিচারে যে ব্যক্তি উত্‌রে যাবে সে-ই হচ্ছে সফলকাম আর সেখানে যে উত্‌রোবে না, সে ব্যর্থ।এ সমগ্র আকীদা-বিশ্বাসগুলোকে যারা মনে-প্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি, তারা কুরআন থেকে কোনক্রমেই উপকৃত হতে পারবে না। কারণ এ বিষয়গুলো অস্বীকার করা তো দূরের কথা এগুলো সম্পর্কে কারো মনে যদি সামান্যতম দ্বিধা ও সন্দেহ থেকে থাকে, তাহলে মানুষের জীবনের জন্য কুরআন যে পথনির্দেশ করেছে সে পথে তারা চলতে পারবে না।
أُوْلَـئِكَ عَلَى هُدًى مِّن رَّبِّهِمْ وَأُوْلَـئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (5 তারাই নিজেদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে সুপথ প্রাপ্ত, আর তারাই যথার্থ সফলকাম।
অর্থাৎ যারা উপরে বর্নিত গুনাবলীসমুহ নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করেছে তাদের কথা বলা হয়েছ।আল্লাহ তায়ালা উক্ত আয়াত গুলিতে যখন হেদায়েত প্রাপ্তদের জন্য কিছু করনীয় কাজ দিলেন,আর হেদায়েত প্রাপ্তরা উক্ত গুনাবলী সমূহের বিশ্লেষণ করে দেখলেন যে ইসলাম গ্রহনের পর যে সমস্ত শর্তের আরোপ করা হয়েছে তাতে অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা রয়েছে,অনেক করনীয় বর্জনীয় রয়েছে,অনেক ব্যক্তি স্বার্থের জলাঞ্জলি রয়েছে এ সবকিছু মাথায় রেখে আমরা আল্লাহর প্রদত্ত বিধান কে মেনে নিলাম,আর আল্লাহ তাদের শানে নাযিল করলেন যে তোমরা সফলকাম হয়ে গেছো। إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا سَوَآءٌ عَلَيْهِمْ ءَأَنذَرْتَهُمْ أَمْ لَمْ تُنذِرْهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ যেসব লোক (একথাগুলো মেনে নিতে) অস্বীকার করেছে, তাদের জন্য সমান – তোমরা তাদের সতর্ক করো বা না করো, তারা মেনে নেবে না।
অর্থাৎ ওপরে বর্ণিত শর্ত সমুহ যারা পূর্ণ করেনি অথবা সেগুলোর মধ্য থেকে কোন একটিও গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।অর্থাৎ তারা একদিকে ব্যক্তি স্বার্থ ত্যাগ করে বা তাদের পুরাতন রীতিনীতি ছেড়ে ইসলামের এ সুমহান বানীকে মেনে তো নেই ইনি বরং দম্ভভরে অস্বীকার করেছে
خَتَمَ اللَّهُ عَلٰى قُلُوبِهِمْ وَعَلٰى سَمْعِهِمْ ۖ وَعَلٰىٓ أَبْصٰرِهِمْ غِشٰوَةٌ ۖ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ আল্লাহ তাদের হৃদয়ে ও কানে মোহর মেরে দিয়েছেন এবং তাদের চোখের ওপর আবরণ পড়ে গেছে। তারা কঠিন শাস্তি পাওয়ার যোগ্য
তাফসীর :
আল্লাহ মোহর মেরে দিয়েছিলেন বলেই তারা মেনে নিতে অস্বীকার করেছিল – এটা এ বক্তব্যের অর্থ নয়। বরং এর অর্থ হচ্ছে, যখন তারা ওপরে বর্ণিত মৌলিক বিষয়গুলো প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং নিজেদের জন্য কুরআনের উপস্থাপিত পথের পরিবর্তে অন্য পথ বেছে নিয়েছিল তখন আল্লাহ‌ তাদের হৃদয়ে ও কানে মোহর মেরে দিয়েছিলেন। যে ব্যক্তি কখনো ইসলাম প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন তিনি অবশ্যি এ মোহর লাগার অবস্থার ব্যাপারে বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করে থাকবেন। আপনার উপস্থাপিত পথ যাচাই করার পর কোন ব্যক্তি একবার যখন তাকে প্রত্যাখ্যান করে তখন উল্টো পথে তার মন-মানস এমনভাবে দৌড়াতে থাকে যার ফলে আপনার কোন কথা আর তার বোধগম্য হয় না। আপনার দাওয়াতের জন্য তার কান হয়ে যায় বধির ও কালা। আপনার কার্যপদ্ধতির গুণাবলী দেখার ব্যাপারে তার চোখ হয়ে যায় অন্ধ। তখন সুস্পষ্টভাবে অনুভূত হয় যে, সত্যিই তার হৃদয়ের দুয়ারে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।
وَمِنَ النَّاسِ مَن يَقُولُ ءَامَنَّا بِاللَّهِ وَبِالْيَوْمِ الْءَاخِرِ وَمَا هُم بِمُؤْمِنِينَ কিছু লোক এমনও আছে যারা বলে, আমরা আল্লাহর ওপর ও আখেরাতের দিনের ওপর ঈমান এনেছি, অথচ আসলে তারা মু’মিন নয়।
এখানে মোনাফেকদের প্রথম আলোচনা করা হয়েছে কোরআনের আলোচনা দৃষ্টিতে এটা পরিস্কার যে মুখোশধারী স্বার্থপর ক্ষমতা লোভী রা এখানে ধোকাবাজির পায়তারা করছে।আল্লাহ তায়ালা প্রথমেই তাদের ইমানদার না হওয়ার ঘোষনা দিচ্ছে।
يُخٰدِعُونَ اللَّهَ وَالَّذِينَ ءَامَنُوا وَمَا يَخْدَعُونَ إِلَّآ أَنفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ তারা আল্লাহর সাথে ও যারা ঈমান এনেছে তাদের সাথে ধোঁকাবাজি করছে। কিন্তু আসলে তারা নিজেদেরকেই প্রতারণা করছে, তবে তারা এ ব্যাপারে সচেতন নয়।
তাফসীর
অর্থাৎ তাদের মুনাফেকী কার্যকলাপ এবং ছদ্মবেশী তাদের জন্য লাভজনক হবে – এ ভুল ধারণায় তারা নিমজ্জিত হয়েছে। অথচ এসব তাদেরকে দুনিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং আখেরাতেও। একজন মুনাফিক কয়েকদিনের জন্য দুনিয়ায় মানুষকে ধোঁকা দিতে পারে কিন্তু সবসময়ের জন্য তার এই ধোঁকাবাজি চলতে পারে না। অবশেষে একদিন তার মুনাফিকীর গুমোর ফাঁক হয়ে যাবেই। তখন সমাজে তার সামান্যতম মর্যাদাও খতম হয়ে যাবে। আর আখেরাতের ব্যাপারে বলা যায়, সেখানে তো ঈমানের মৌখিক দাবীর কোন মূল্যই থাকবে না যদি আমল দেখা যায় তার বিপরীত।
فِى قُلُوبِهِم مَّرَضٌ فَزَادَهُمُ اللَّهُ مَرَضًا ۖ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌۢ بِمَا كَانُوا يَكْذِبُونَ তাদের হৃদয়ে আছে একটি রোগ, আল্লাহ‌ সে রোগ আরো বেশী বাড়িয়ে দিয়েছেন, আর যে মিথ্যা তারা বলে তার বিনিময়ে তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
তাফসীর
মুনাফিকীকেই এখানে তাদের ক্বলবের রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর আল্লাহ‌ এ রোগ আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন, একথার অর্থ হচ্ছে এই যে, তিনি কালবিলম্ব না করে ঘটনাস্থলেই মুনাফিকদেরকে তাদের মুনাফিকী কার্যকলাপের শাস্তি দেন না বরং তাদেরকে ঢিল দিতে থাকেন। এর ফলে মুনাফিকরা নিজেদের কলা-কৌশলগুলোকে আপাতঃ দৃষ্টিতে সফল হতে দেখে আরো বেশী ও পূর্ণ মুনাফিকী কার্যকলাপে লিপ্ত হতে থাকে।
وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ لَا تُفْسِدُوا فِى الْأَرْضِ قَالُوٓا إِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُونَ যখনই তাদের বলা হয়েছে, যমীনে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করো না, তারা একথাই বলেছে, আমরা তো সংশোধনকারী।
ইসলামের দাওয়াতের কাজ যখন চলছিল মোনাফেকরা তখন মানুষকে ইসলাম সম্পর্কে গোপনে বিরূপ ভাবে তুলে ধরছিল এবং মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব ফেৎনা ফ্যাসাদ সৃষ্টি করছিল। এই আয়াতের বাহ্যিক অর্থ দৃষ্টে মনে হয় এই আয়াত তদানিন্তন মোনাফেকদের জন্য প্রযোজ্য আসলে ব্যাপারটা এরকম না।এটা কোরআনের সার্বজনীন সর্ব কালের মোনাফেকদের জন্য প্রযোজ্য।মোনাফেক যে যুগেরই হোক তাদের আচরন এমনই হবে।
أَلَآ إِنَّهُمْ هُمُ الْمُفْسِدُونَ وَلٰكِن لَّا يَشْعُرُونَ সাবধান! এরাই ফাসাদ সৃষ্টিকারী, তবে তারা এ ব্যাপারে সচেতন নয়।
আল্লাহর বান্দাদেরকে আল্লাহু ওদের ব্যাপারে সাবধান করছেন,এবং আল্লাহ নিশ্চিত করে বান্দাদেরকে চিনিয়ে দিচ্ছেন যে মোনাফেকরাই দুনিয়াতে ফ্যাসাদ সৃষ্টি কারী।এই দুনিয়ার যেখানেই ফেনা ফ্যাসাদ হয়েছে তা ঐ কওমের মোনা ফেক দের দ্বারাই বেশি হয়েছে।
وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ ءَامِنُوا كَمَآ ءَامَنَ النَّاسُ قَالُوٓا أَنُؤْمِنُ كَمَآ ءَامَنَ السُّفَهَآءُ ۗ أَلَآ إِنَّهُمْ هُمُ السُّفَهَآءُ وَلٰكِن لَّا يَعْلَمُونَ আর যখন তাদের বলা হয়েছে, অন্য লোকেরা যেভাবে ঈমান এনেছে তোমরাও সেভাবে ঈমান আনো। তখন তারা এ জবাবই দিয়েছে- আমরা কি ঈমান আনবো নির্বোধদের মতো?সাবধান! আসলে এরাই নির্বোধ, কিন্তু এরা জানে না।
তাফসীর :
অর্থাৎ তোমাদের এলাকার অন্যান্য লোকেরা যেমন সাচ্চা দিলে ও সরল অন্তঃকরণে মুসলমান হয়েছে তোমরাও যদি ইসলাম গ্রহণ করতে চাও তাহলে তেমনি নিষ্ঠা সহকারে সাচ্চা দিলে গ্রহণ করো। যারা সাচ্চা দিলে নিষ্ঠা সহকারে ইসলাম গ্রহণ করে নিজেদেরকে উৎপীড়ন, নির্যাতন, কষ্ট ও বিপদের মুখে নিক্ষেপ করছিল তাদেরকে তারা নির্বোধ মনে করতো। তাদের মতে নিছক সত্য ও ন্যায়ের জন্য সারা দেশের জনসমাজের শত্রুতার মুখোমুখি হওয়া নিরেট বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা মনে করতো, হক ও বাতিলের বিতর্কে না পড়ে সব ব্যাপারেই কেবলমাত্র নিজের স্বার্থের দিকে দৃষ্টি রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ।
وَإِذَا لَقُوا الَّذِينَ ءَامَنُوا قَالُوٓا ءَامَنَّا وَإِذَا خَلَوْا إِلٰى شَيٰطِينِهِمْ قَالُوٓا إِنَّا مَعَكُمْ إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِءُونَ যখন এরা মু’মিনদের সাথে মিলিত হয়, বলেঃ “আমরা ঈমান এনেছি”, আবার যখন নিরিবিলিতে নিজেদের শয়তানদের সাথে মিলিত হয় তখন বলেঃ “আমরা তো আসলে তোমাদের সাথেই আছি আর ওদের সাথে তো নিছক তামাশা করছি।”
তাফসীর :
আরবী ভাষায় সীমালংঘনকারী, দাম্ভিক ও স্বৈরাচারীকে শয়তান বলা হয়। মানুষ ও জ্বিন উভয়ের জন্য এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। কুরআনের অধিকাংশ জায়গায় এ শব্দটি জ্বিনদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হলেও কোন কোন জায়গায় আবার শয়তান প্রকৃতির মানুষদের জন্যও ব্যবহার করা হয়েছে। পূর্বাপর আলোচনার প্রেক্ষাপটে এসব ক্ষেত্রে কোথায় শয়তান শব্দটি জ্বিনদের জন্য এবং কোথায় মানুষদের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে তা সহজেই জানা যায়। তবে আমাদের আলোচ্য স্থানে শয়তান শব্দটিকে বহুবচনে ‘শায়াতীন’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এবং এখানে শায়াতীন বলতে মুশরিকদের বড় বড় সরদারদেরকে বুঝানো হয়েছে। এ সরদাররা তখন ইসলামের বিরোধিতার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছিল। এটাও মুনাফিকদের একটি মুখের কথা যা তাদের অন্তরে নেই। যখন তারা মু’মিনদের সাথে একত্রিত হয় তখন নিজেদেরকে ঈমানদার দাবি করে, আবার যখন তাদের শয়তান সাথীদের সাথে মিলিত হয় তখন তারা তাদেরকে বলে আমরা তোমাদের সঙ্গেই আছি। বিশিষ্ট তাবেয়ী সুদ্দী ইমাম মালিক (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, এখানে شَیٰطِیْنِھِمْ (শয়তান) দ্বারা উদ্দেশ্য হল- মুশরিক, মুনাফিক ও ইয়াহূদীদের নেতা ও সর্দার। (তাফসীর ইবনে কাসীর ১/১৩৮) ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন, প্রত্যেক পথভ্রষ্টকারী ও অবাধ্যকে শয়তান বলা হয়। তারা জিন ও মানব উভয় জাতি থেকে হতে পারে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (وَکَذٰلِکَ جَعَلْنَا لِکُلِّ نَبِیٍّ عَدُوًّا شَیٰطِیْنَ الْاِنْسِ وَالْجِنِّ یُوْحِیْ بَعْضُھُمْ اِلٰی بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُوْرًا) “অনুরূপভাবে আমি মানব ও জিনের মধ্যে যারা শয়তান তাদেরকে প্রত্যেক নাবীর শত্র“ করেছি, প্রতারণার উদ্দেশ্যে তাদের একে অন্যকে চমকপ্রদ কথা অতি গোপনীয়ভাবে জানিয়ে দেয়।”(সূরা আন‘আম ৬:১১২) সুতরাং মুনাফিকরা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য অথবা অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যখন ঈমানের কথা বলা দরকার তখন ঈমানের কথা বলে আর যখন কুফরী করা প্রযোজন হবে তখন কুফরী করে। (إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِئُوْنَ) ‏ ‘নিশ্চয়ই আমরা তো শুধু ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে থাকি’অর্থাৎ মুনাফিকরা তাদের শয়তান সাথীদের বলে: আমরা মু’মিনদের সাথে ঈমানের কথা বলে ঠাট্টা করি। মু’মিনদের সাথে ঠাট্টার বদলাস্বরূপ আল্লাহ তা‘আলাও তাদের সাথে ঠাট্টা করেন। আল্লাহ তা‘আলার ঠাট্টা করা হল: তারা যে দুর্ভাগা ও খারাপ অবস্থায় আছে তা তাদের কাছে চাক্যচিক্য করে তুলে ধরেছেন, ফলে তাদের ধারণা যে তারা মু’মিনদের শামিল। আবার কিয়ামতের দিন তাদের সাথে ঠাট্টা করবেন এভাবে যে, মু’মিনদের মত তাদেরকেও পথ চলার জন্য বাহ্যিক নূর দেবেন কিন্তু যখন পথ চলতে শুরু করবে তখন তাদের নূর নিভে যাবে, ফলে অন্ধকারে নিরাশ হয়ে পড়ে থাকবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (یَوْمَ یَقُوْلُ الْمُنٰفِقُوْنَ وَالْمُنٰفِقٰتُ لِلَّذِیْنَ اٰمَنُوا انْظُرُوْنَا نَقْتَبِسْ مِنْ نُّوْرِکُمْﺆ قِیْلَ ارْجِعُوْا وَرَا۬ءَکُمْ فَالْتَمِسُوْا نُوْرًاﺚ فَضُرِبَ بَیْنَھُمْ بِسُوْرٍ لَّھ۫ بَابٌﺚ بَاطِنُھ۫ فِیْھِ الرَّحْمَةُ وَظَاھِرُھ۫ مِنْ قِبَلِھِ الْعَذَابُ) “সেদিন মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী মু’মিনদেরকে বলবেঃ তোমরা আমাদের জন্য একটু অপেক্ষা কর, যাতে আমরা তোমাদের নূর হতে কিছু গ্রহণ করতে পারি। বলা হবেঃ তোমরা তোমাদের পেছনে ফিরে যাও ও আলোর সন্ধান কর। অতঃপর উভয়ের মাঝামাঝি স্থাপিত হবে একটি প্রাচীর। সেখানে একটি দরজা থাকবে, যার অভ্যন্তরে রহমত এবং বহির্ভাগে আযাব।”(সূরা হাদীদ ৫৭:১৩) ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: ‘‘المكر و الخداع والسخرية ‘‘ অর্থাৎ ষড়যন্ত্র করা, ধোঁকা দেয়া ও ঠাট্টা করা ইত্যাদি স্বভাবসমূহ বিনা কারণে আল্লাহ তা‘আলার শানে ব্যবহার করা সমীচীন নয়। তবে শাস্তি ও বদলাস্বরূপ ব্যবহৃত হলে কোন নিষেধ নেই। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর) মূলতঃ কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলার জন্য ঐ জাতীয় শব্দগুলো ব্যবহার হয়েছে শাস্তি ও প্রতিফল প্রদানের ক্ষেত্রে। অতএব ঐ স্বভাবগুলো আল্লাহ তা‘আলার জন্য ব্যবহার হলে মাখলুকের ন্যায় ধারণা করা বৈধ হবে না। (وَيَمُدُّهُمْ فِيْ طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُوْنَ) ‘তাদেরকে (তাদের) নিজেদের অবাধ্যতার মধ্যে বিভ্রান্ত হয়ে ফেরার জন্য ঢিল দেন’ইবনু আব্বাস, ইবনু মাসউদ (রাঃ) ও কতক সাহাবী হতে বর্ণিত তারা বলেন: يمدهم এর অর্থ হচ্ছে يملي عليهم অর্থাৎ তাদেরকে অবকাশ দেন। মুজাহিদ বলেন: يمدهم এর অর্থ বৃদ্ধি করে দেয়া। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (اَیَحْسَبُوْنَ اَنَّمَا نُمِدُّھُمْ بِھ۪ مِنْ مَّالٍ وَّبَنِیْنَﮆﺫ نُسَارِعُ لَھُمْ فِی الْخَیْرٰتِﺚ بَلْ لَّا یَشْعُرُوْنَ) “তারা কি মনে করে যে, আমি তাদেরকে সাহায্যস্বরূপ যে ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি দান করি, তা দ্বারা তাদের জন্য সকল প্রকার মঙ্গল ত্বরান্বিত করছি? না, বরং তারা বুঝে না।”(সূরা মু’মিনুন ২৩:৫৫-৫৬) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন: (سَنَسْتَدْرِجُهُمْ مِّنْ حَيْثُ لَا يَعْلَمُونَ) “এমনভাবে ক্রমে ক্রমে তাদেরকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাই যে, তারা জানতেও পারবে না।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১৮২) কেউ কেউ বলেছেন: যখনই তারা নতুন নতুন পাপকাজ করেছে আল্লাহ তা‘আলা তখনই তাদের দুনিয়ার ধন-সম্পদ ও ঐশ্বর্য আরো বৃদ্ধি করে দিয়েছেন। যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিতে তা ছিল নেয়ামত; প্রকৃতপক্ষে তা ছিল শাস্তি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (فَلَمَّا نَسُوْا مَا ذُکِّرُوْا بِھ۪ فَتَحْنَا عَلَیْھِمْ اَبْوَابَ کُلِّ شَیْءٍﺚ حثج اِذَا فَرِحُوْا بِمَآ اُوْتُوْٓا اَخَذْنٰھُمْ بَغْتَةً فَاِذَا ھُمْ مُّبْلِسُوْنَ) “তাদেরকে যে উপদেশ দেয়া হয়েছিল তারা যখন তা বিস্মৃত হল তখন আমি তাদের জন্য সমস্ত কিছুর দ্বার উন্মুক্ত করে দিলাম; অবশেষে তাদেরকে যা দেয়া হল যখন তারা তাতে উল্লসিত হল, অতঃপর হঠাৎ তাদেরকে ধরলাম; ফলে তখনি তারা নিরাশ হল।”(সূরা আন‘আম ৬:৪৪) ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: সঠিক কথা হল তাদের ঔদ্ধত্যতার অবকাশ দেয়ার জন্য আল্লাহ তা‘আলা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (وَنُقَلِّبُ اَفْئِدَتَھُمْ وَاَبْصَارَھُمْ کَمَا لَمْ یُؤْمِنُوْا بِھ۪ٓ اَوَّلَ مَرَّةٍ وَّنَذَرُھُمْ فِیْ طُغْیَانِھِمْ یَعْمَھُوْنَ) “তারা যেমন প্রথমবারে তাতে ঈমান আনেনি আমিও তাদের মনোভাবের ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে দেব এবং তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় উদভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়াতে দেব।”(সূরা আন‘আম ৬:১১০) ইবনু আব্বাস (রাঃ), কাতাদাহ, মুজাহিদ, আবুল আলিয়া (রহঃ) প্রমুখ বলেন: (فِيْ طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُوْنَ) এর অর্থ হচ্ছে তারা তাদের কুফরীতে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, হীনতায় উদভ্রান্ত। (তাফসীর ইবনে কাসীর ১/১৪০) আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. মুনাফিকরা নিজেদের ঘৃণ্য চরিত্র চরিতার্থ করার জন্য দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন করে, সুতরাং তারা কখনও ঈমানদার নয় প্রকৃতপক্ষে তারা মিথ্যুক। ২. আল্লাহ তা‘আলা বে-ঈমানদেরকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে কুফরীর অবকাশ প্রদান করেন তাদের পরকালীন শাস্তি আরো বৃদ্ধি করার জন্য। ৩. মানুষ শয়তানরা জিন শয়তান থেকে অধিক ক্ষতিকর, মুনাফিকরাই মানুষ শয়তান।
اَللّٰہُ یَسۡتَہۡزِئُ بِہِمۡ وَ یَمُدُّہُمۡ فِیۡ طُغۡیَانِہِمۡ یَعۡمَہُوۡنَ۵ আল্লাহ তাদের সাথে পরিহাস করেন(১) আর তাদের অবাধ্যতায় তাদেরকে বিভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়াবার অবকাশ দেন।
তাফসীর
'আল্লাহ তাদের সাথে পরিহাস করেন'-এর একটি অর্থ হল, যেভাবে তারা মুসলিমদের সাথে উপহাস ও বিদ্রূপমূলক কার্যকলাপ করে, আল্লাহও তাদের সাথে অনুরূপ কার্যকলাপ ক'রে তাদেরকে লাঞ্ছিত ও অপদস্থ করেন। এটাকে ভাষাগত ব্যবহারে 'পরিহাস' বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে তা পরিহাস নয়, বরং তা আসলে তাদের পরিহাস কর্মের শাস্তি। যেমন "মন্দের প্রতিফল তো অনুরূপ মন্দই।" (সূরা শূরা ৪২:৪০ আয়াত) এই আয়াতে মন্দের প্রতিফলকেও মন্দ বলা হয়েছে। অথচ তা মন্দ নয়; বরং তা একটি বৈধ কাজ। তদনুরূপ "নিশ্চয় মুনাফিক (কপট) ব্যক্তিরা আল্লাহকে প্রতারিত করতে চায়। বস্তুত তিনিও তাদেরকে প্রতারিত ক'রে থাকেন।" (সূরা নিসা ৪:১৪২ আয়াত) "অতঃপর তারা ষড়যন্ত্র করল এবং আল্লাহও কৌশল প্রয়োগ করলেন।" (আলে ইমরান ৩:৫৪ আয়াত) প্রভৃতি আয়াতসমূহেও অনুরূপ এসেছে। এর দ্বিতীয় অর্থ হল, কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহও তাদের সাথে উপহাস করবেন। যেমন সূরা হাদীদ ৫৭:১৩ নং আয়াতে এর পরিষ্কার বর্ণনা রয়ে
তাফসীরের আবু বকর যাকারিয়াতে দলিল সহকারে আরো কিছু বর্ণনা করা হয়েছে আল্লাহ্‌ তাদের সাথে উপহাস করেন,অর্থাৎ তাদেরকে এবং তাদের অবাধ্যতার মধ্যে বিভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়াবার অবকাশ দেন। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, "আল্লাহ তা'আলা তাদের থেকে বদলা নেয়ার জন্য তাদের সাথে উপহাস করেছেন। কাফেরদের ঠাট্টা বা উপহাসের বিপরীতে আল্লাহ তা'আলা কর্তৃক তাদের সাথে উপহাস বা ঠাট্টা করা দোষণীয় কিছু নয়। বরং এটা আল্লাহর এমন এক কর্মবাচক গুণ যা হওয়া জরুরী। কেননা, আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করার দিক থেকে বিভিন্ন গুণাগুণ চার প্রকারঃ ১) এমন কিছু গুণ রয়েছে, যেগুলো গুণ হিসেবে পরিপূর্ণ ও উত্তম তবে কখনো কখনো এগুলো থেকে মন্দ অর্থও বুঝা যায়। এরূপ গুণসমূহ থেকে আল্লাহর নাম গ্রহণ করা যাবে না। বরং গুণ হিসেবে উল্লেখ করতে হবে। যেমন, কালামুল্লাহ' (আল্লাহর কথাবার্তা), ইরাদা’ (আল্লাহর ইচ্ছা) এগুলো আল্লাহর গুণ হিসেবে ব্যবহার হবে অর্থাৎ গুণ হিসেবে তাকে মুতাকাল্লেম’ ও ‘মুরীদ বলা যাবে। কিন্তু এগুলো থেকে আল্লাহর নাম গ্রহণ করে আল্লাহ তা'আলাকে মুতাকাল্লেম’ ও মুরাদ' নাম দেয়া যাবে না। কেননা, কথাবার্তায় ভাল-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, ইনসাফ-যুলুম সবকিছুই থাকে। ইচ্ছাও তদ্রুপ উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কাউকে আব্দুল মুতাকাল্লেম বা আব্দুল মুরীদ বলা যাবে না এবং আল্লাহকে ডাকার জন্য ইয়া মুতাকাল্লেম! ইয়া মুরাদ' বলা যাবে না। ২) এমনকিছু গুণ রয়েছে যেগুলো পুরোপুরিভাবেই উত্তম গুণ। সেগুলো কোন মন্দ অর্থে ব্যবহৃত হয় না। এগুলো গুণ হিসেবে যেমন ব্যবহৃত হয় তেমনিভাবে এগুলো থেকে নামও গ্রহণ করা যাবে আর আল্লাহর অধিকাংশ নামও এ ধরণের গুণসমৃদ্ধ। যেমন, রাহমান, রাহীম, সামী', বাহীর ইত্যাদি। এগুলো থেকে তার নাম সাব্যস্ত হওয়ার সাথে সাথে তার জন্য দয়া, করুণা, শুনা ও দেখার গুণসমূহও সাব্যস্ত হবে। ৩) এমনকিছু গুণ রয়েছে যেগুলো সাধারণতঃ উত্তম গুণ নয়। বিশেষ বিশেষ অবস্থায় তা উত্তম গুণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এগুলো বিশেষ বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতেই শুধু আল্লাহর গুণ হিসেবে ব্যবহৃত হবে। যেমন, ধোকা, কারসাজি, ঠাট্টা, কৌশল ইত্যাদি আল্লাহর জন্য ব্যবহার করে বলা যাবে না যে, আল্লাহ ধোকা দেন, ঠাট্টা করেন ইত্যাদি। কিন্তু এভাবে বলা যাবে যে, আল্লাহ্ তা'আলা যারা তার রাসূলের সাথে ঠাট্টা করে, ধোকাবাজি করে তাদের সাথে ঠাট্টা করেন, ধোকা দেন। এর দ্বারা আল্লাহর কোন অসম্মান বুঝা যায় না। ৪) এমনকিছু গুণ রয়েছে যেগুলো কোন অবস্থাতেই উত্তমগুণ নয়। যেমন, অপারগতা, দুর্বলতা, অন্ধত্ব, বধিরতা ইত্যাদি। এ জাতীয় গুণাবলী আল্লাহর জন্য কোন অবস্থাতেই সাব্যস্ত করা যাবে না। উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমাদের কাছে স্পষ্ট হলো যে, যারা আল্লাহ এবং তার রাসূলের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে তাদের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা আল্লাহর উত্তম গুণের অন্তর্ভুক্ত। [মুহাম্মাদ ইবনে সালেহ আল-উসাইমীন: আল-কাওলুল মুফীদ]
اُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ اشۡتَرَوُا الضَّلٰلَۃَ بِالۡہُدٰی ۪ فَمَا رَبِحَتۡ تِّجَارَتُہُمۡ وَ مَا کَانُوۡا مُہۡتَدِیۡنَ তারাই হিদায়াতের বিনিময়ে ভ্রষ্টতা ক্রয় করেছে। কিন্তু তাতে তাদের ব্যবসা লাভজনক হয়নি। আর তারা সৎপথপ্রাপ্তও নয়।
ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) এবং আরো কয়েকজন সাহাবী থেকে বর্ণিত। তারা হিদায়াতকে ছেড়ে গোমরাহীকে গ্রহণ করেছিলো। ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেনঃ ‘ঈমানের পরিবর্তে কুফরীকে গ্রহণ করেছিলো।’ (দীসটির সনদ য‘ঈফ) মুজাহিদ (রহঃ) বলেনঃ তারা ঈমান আনার পরে কাফির হয়েছিলো।’ কাতাদাহ (রহঃ) বলেনঃ ‘তারা হিদায়াতের চেয়ে গোমরাহীকেই অধিক পছন্দ করেছিলো।’ যেমন অন্যস্থানে সামূদ সম্প্রদায় সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেনঃ ﴿وَ اَمَّا ثَمُوْدُ فَهَدَیْنٰهُمْ فَاسْتَحَبُّوا الْعَمٰى عَلَى الْهُدٰى﴾ আর সামূদ সম্প্রদায়ের ব্যাপার তো এই যে, আমি তাদেরকে পথ নির্দেশ করেছিলাম, কিন্তু তারা সৎ পথের পরিবর্তে ভ্রান্ত পথ অবলম্বন করেছিলো। (৪১ নং সূরাহ্ হা-মীম সাজদাহ, আয়াত নং ১৭) ভাবার্থ্য এই যে, মুনাফিকরা হিদায়াত হতে সরে গিয়ে গোমরাহীর ওপর এসে গেছে এবং হিদায়াতের পরিবর্তে গোমরাহীকেই গ্রহণ করেছে। তারা ঈমান এনে পুনরায় কাফির হয়েছে। হয়তো বা আসলেই ঈমান লাভের সৌভাগ্য হয়নি। যেমন কুর’আনুল কারীমে বলা হয়েছেঃ ﴿ذٰلِكَ بِاَنَّهُمْ اٰمَنُوْا ثُمَّ كَفَرُوْا فَطُبِعَ عَلٰى قُلُوْبِهِمْ﴾ এটা এ জন্য যে, তারা ঈমান আনার পর কুফরী করেছে; ফলে তাদের হৃদয় মোহর করে দেয়া হয়েছে। (৬৩ নং সূরাহ্ মুনাফিকূন, আয়াত নং ৩) মুনাফিকদের মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের লোক ছিলো। আবার এমনও মুনাফিক ছিলো যাদের ভাগ্যে ঈমান লাভই ঘটেনি। এ জন্যই মহান আল্লাহ বলেন যে, এরা তারাই যারা সু-পথের পরিবর্তে কুপথকে ক্রয় করেছে, সুতরাং তাদের বাণিজ্য লাভজনক হয়নি এবং তারা সরল সঠিক পথে চলেনি। সুতরাং এরা এই সওদায় কোন উপকারও লাভ করেনি এবং সু-পথও প্রাপ্ত হয়নি, বরং হিদায়াতের বাগান থেকে বের হয়ে কাঁটার জঙ্গলে পড়ে গেছে। (তাফসীর তাবারী ১/৩১৬) নিরাপত্তার প্রশস্ত মাঠ থেকে বেরিয়ে ভীতিপ্রদ অন্ধকার ঘরে এবং সুন্নাতের পবিত্র বাগান হতে বের হয়ে বিদ‘আতের শুষ্ক জঙ্গলে এসে পড়েছে। (তাফসীর ইবনু আবী হাতিম ১/৬০)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন