উপমহাদেশে ইসলাম ও কওমী আলিয়ার দ্বন্দ
আব্দুল হান্নান
মুহাম্মদ বিন কাসিম একজন বাহাদুর যোদ্ধা ছিলেন। তবে ঐতিহাসিকভাবে এ কথা মোটেও ঠিক নয় যে, উপমহাদেশে তিনি প্রথম ইসলাম নিয়ে এসেছেন। তার আগমনের আগেই এখানে ইসলাম পৌঁছেছিল। ২৫ জন সাহাবী রা:ব্যবসা উপলক্ষে সিন্ধু ও বেলুচিস্তানে যাঁদের আগমনের ধারা হজরত উমর ফারুক রা:-এর খেলাফতের সময় শুরু হয় তিনারা পাশাপাশি দ্বীনের দাওয়াতী কাজের পরিবেশ ও আভিযানিক কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য পযর্বেক্ষন করতে থাকেন। , রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবি মুগীরা বিন আবুল আস সাকাফী রা: সিন্ধুর দেবল শহর জয় করেন। তাঁর ভাই হাকাম বিন আবুল আস রা: ভারতের গুজরাট ও কাথিয়াবাড় অঞ্চল জয় করেন। ওই সময় সাহাবায়ে কেরাম রা:-এর একটি দল মাকরানও জয় করেন। এসব বিজয় হজরত উসমান বিন আবুল আস সাকাফী রা:-এর তত্ত্বাবধানে পরিপূর্ণ হয়, যিনি ওমান ও বাহরাইনের গভর্নর ছিলেন। মাওলানা ইসহাক ভাট্টি এ ঘটনাবলি বালাযুরীর গ্রন্থ ফুতুহুল বুলদান-এর উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন। উমাইয়া শাসক আবদুল মালেক বিন মারওয়ানের শাসনামলে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ইরাকের গভর্নর ছিলেন। ওমান ও সিন্ধু অঞ্চলে মুয়াবিয়া বিন হারেস আলাফী ও তার ভাই মুহাম্মদ বিন হারেস আলাফী খলিফা মারওয়ানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। ওই বিদ্রোহীরা রাজা দাহিরের সাহায্য পেয়েছিলেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ বারবার রাজা দাহিরকে পত্র পাঠান, তিনি যেন বিদ্রোহীদের সাহায্য করা থেকে বিরত থাকেন। ওই সময়েই সিলোনের (শ্রীলঙ্কা) কিছু মুসলমান পরিবার সমুদ্রপথে ওমান যাচ্ছিল। জলদস্যুরা তাদের মালামাল লুট করে নেয়। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ রাজা দাহিরের কাছে জলদস্যুদের শাস্তি দাবি করেন। কেননা লুটের ঘটনা দেবলের বন্দরে ঘটেছিল। রাজা দাহির এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর মুহাম্মদ বিন কাসিমকে রাজা দাহিরের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়। রাজা দাহিরকে পরাভূতকারী মুহাম্মদ বিন কাসিমকে নতুন শাসক সুলায়মান বিন আবদুল মালিকের নির্দেশে গ্রেফতার এবং হত্যা করা হয়। এই যুবক সিপাহসালার সিন্ধু, রাজস্থান, গুজরাট ও কাথিয়াবাড়ে বেশ কিছু মসজিদ ও মাদরাসা নির্মাণ করেন। তবে তার আগমনের আগে থেকেই এ অঞ্চলে ইসলাম বিদ্যমান ছিল। তিনি বিজিত অঞ্চলে জুলুম-অত্যাচার করা থেকে দূরে থাকেন এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেন। এ কারণে তার মর্মান্তিক মৃত্যুতে গুজরাটের ক্ষীরা শহরে হিন্দুরা তার ভাস্কর্য নির্মাণ করে শহরের মাঝে স্থাপন করে। মুহাম্মদ বিন কাসিম তার বাহিনীতে অনেক অমুসলিমকেও নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি ওই ধরনের যুদ্ধবাজ ছিলেন না, যিনি তরবারির জোরে ইসলাম প্রসারের চেষ্টা করেছেন। ইসলাম প্রচার ও প্রসারের কাজ ওই উলামা ও বুজুর্গ ব্যক্তিরা করেছেন, যারা সমুদ্রপথে সিন্ধু ও বেলুচিস্তান আসেন। এ ছাড়া অনেক বুজুর্গ মধ্য এশিয়ার স্থলপথ দিয়ে আফগানিস্তান ও কাশ্মিরে আসেন এবং ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটান। মাওলানা ইসহাক ভাট্টি তার গ্রন্থে এমন ১৮ জন বুজুর্গের কথাও উল্লেখ করেছেন, যারা আরব ভূখণ্ড থেকে এসে সিন্ধু ও হিন্দুস্তানে স্থায়ী হন। সেখানে হজরত আবদুল্লাহ শাহ গাজী রা:-এর নাম উল্লেখ করা হয়নি, করাচির ক্লিফটনে যার মাজার রয়েছে। এর অর্থ, তিনিও মুহাম্মদ বিন কাসিমের মতো অনেক পরে সিন্ধুতে আসেন। আবদুল্লাহ শাহ গাজী রা: সুফিও ছিলেন, মুজাহিদও ছিলেন। সুফিরা তরবারির মাধ্যমে ইসলাম প্রচার-প্রসার করেন না। তবে যেখানে মুসলমানদের ওপর জুলুম সীমা ছাড়িয়ে যায়, সেখানে তারা মুজাহিদদের সঙ্গী হন এবং তরবারি হাতে উঠিয়ে নেন। আজমিরের রাজা পৃথ্বিরাজ চৌহানের সাথে হজরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী রা:-এর লড়াইয়ের কারণও ছিল এটা। ওই বুজুর্গ পৃথ্বিরাজ চৌহানের মোকাবেলায় মুহাম্মদ ঘুরীকে প্রকাশ্যে সমর্থন ও সঙ্গ দেন। আজমিরে আজো ওইসব শহীদের কবর টিকে রয়েছে, যারা খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী রা:-এর নির্দেশে পৃথ্বিরাজ চৌহানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী রা: ও মুহাম্মদ ঘুরী আফগানিস্তানের অধিবাসী ছিলেন। আজ ঘুরী পাকিস্তানের হিরো এবং পৃথ্বি হিন্দুস্তানের হিরো। পাকিস্তান তার ক্ষেপণাস্ত্রের নাম ঘুরী ও গজনবী রেখেছে, যারা ছিলেন আফগান। অথচ কিছু আফগান আজ পৃথ্বি নাম জপকারীদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সত্য তো এটা, মুসলমান ঐক্যবদ্ধ এক জাতি হয়ে থাকলে দুনিয়ার বড় বড় শক্তি তাদের কিছুই করতে পারত না। কিন্তু যখন সুলায়মান বিন আবদুল মালিকের মতো কুচক্রী শাসক মুহাম্মদ বিন কাসিমকে হত্যা করতে থাকে, তখন শত্রু আমাদের ঘরে ঢুকে গিয়ে আমাদের মারতে থাকে। আমাদের মুহাম্মদ বিন কাসিমের পরিণাম থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে একে অন্যকে হত্যা করানোর ষড়যন্ত্র ও কুচক্র পরিত্যাগ করতে হবে।
এখন ভারত বর্ষে মুসলমানদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করবো। ভারতবর্ষে মাদ্রাসা শিক্ষার সূচনা হয় ৭১১ সালে, মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের পর পরই। সিন্ধু বিজয়ের হাত ধরে ভারতে মাদ্রাসা শিক্ষা বা ইসলামী শিক্ষার যাত্রা শুরু হলেও প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয় এরও বেশ কিছুকাল পর। মুহাম্মদ ঘুরী ১২০০ শতকের শেষদিকে ভারতে তুর্কি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ১১৯১ সালে তিনি আজমীরে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর মোগল আমলে ভারতবর্ষে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার বিস্তার ঘটে। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসকদের শাসনামলে শিক্ষাব্যবস্থা ও ধর্ম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল। মুসলিম শাসনামলে শিক্ষা ও ধর্মকে অত্যন্ত অঙ্গাঙ্গিভাবে বিবেচনা করা হতো। ’ সে আমলে মুসলিম পরিবারের শিশুদের হাতেখড়ি হতো পবিত্র কোরআনের শিক্ষার মাধ্যমে। ইতিহাসবিদ এ আর মল্লিক লিখেছেন: ‘বাংলার মুসলমানদের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে যখন কোনো সন্তানের বয়স চার বছর চার মাস চার দিন পূর্ণ হতো, তখন তার বিদ্যাশিক্ষার সূচনা হতো। একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পবিত্র কোরআনের কিছু অংশ শিশুকে পাঠ করে শোনানো হতো। শিশু তা পুনরাবৃত্তি করত। এ ছিল প্রতিটি মুসলিম পরিবারের অপরিহার্য প্রথা। সুলতানি আমলে মাদ্রাসা শিক্ষা তেরো শতকের প্রারম্ভে ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজির বাংলার একটি সীমান্তবর্তী অঞ্চল নদিয়া জয়ের মাধ্যমে বাংলায় প্রথমবারের মতো মুসলিম শাসনের সূত্রপাত হয়। পরবর্তী সময়ে প্রায় শত বছরের মধ্যেই সারা বাংলায় মুসলিম শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। ১২৫৩ খ্রিস্টাব্দে সারা বাংলাকে একত্র করে সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ স্বাধীন বাংলার মুসলিম রাষ্ট্র গঠন করেন। পরবর্তী সময়ে এটি প্রায় কয়েক শ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে টিকে থাকে। ভারতে ‘দিল্লি সুলতানাত’ স্থায়ী হয় প্রায় ৩২৫ বছর (১২০১-১৫২৮)। কারো কারো মতে, ৩২০ বছর (১২০৬-১৫২৬)। চারজন তুর্কি ও একজন আফগান বংশোদ্ভূত সুলতান এই সময় দিল্লি ও এর আশপাশের এলাকা নিয়ে সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। এ সময় ভারতে ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই উদ্যোগের একটি প্রধান দিক ছিল মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণ। দিল্লিতে প্রথম মাদ্রাসা স্থাপিত হয় শামসুদ্দিন ইলতুিমশের আমলে (১২১১-১২৩৬)। তাঁর শাসনামলে গোটা দিল্লি নগরী তদানীন্তন ভারতের জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে গৌরব ও মর্যাদা লাভ করেছিল। দিল্লি সুলতানাতের পাঁচটি রাজবংশের মধ্যে তুঘলকদের আমলে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয় সবচেয়ে বেশি। মুহাম্মদ বিন তুঘলকের ২৫ বছরের শাসনামলে কেবল দিল্লিতেই প্রায় এক হাজার মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। ফিরোজশাহ তুঘলক (১৩৫১-১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর রাজত্বকালে শিক্ষা খাতে মোট ১, ৩০, ০০, ০০০ তংকা ব্যয় করেছেন। এ থেকে আলিম ও শিক্ষকরা পেয়েছেন ৩৬, ০০, ০০০ তংকা। অবশিষ্ট অর্থ প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, গ্রন্থ সংগ্রহ, গ্রন্থ প্রকাশনা ইত্যাদি কাজে ব্যয় করা হয়। মোগল আমলে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা ১১৯৭ সালে বখতিয়ার খিলজির সামরিক অভিযানের পর থেকে মাদ্রাসা ও মক্তব শাসকদের অনুদান পেতে থাকে। বখতিয়ার খিলজি নিজে এবং তাঁর পরবর্তী শাসকরাও বেশ কিছু মাদ্রাসা স্থাপন করেন। মোগল আমলে মাদ্রাসার সংখ্যা বহু গুণ বেড়ে যায়। সম্রাট বাবরের আমলের (১৫২৬-১৫৩০) রাজদরবারের কাগজপত্র থেকে জানা যায়, বাবরের প্রশাসন মনে করত, জনগণের শিক্ষা হচ্ছে শাসকের দায়িত্ব। মাদ্রাসায় শিক্ষিত উলামাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে মোগল শাসকদের। এমনকি কোনো কোনো সম্রাট আলেমদের যুদ্ধক্ষেত্রেও নিয়ে যেতেন প্রয়োজনীয় পরামর্শের জন্য। মোগল আমলে আলেমরা প্রধানত তিনটি বিশেষ কাজে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে সহযোগিতা করতেন—এক. রাজপরিবারের শিক্ষাদীক্ষা দেওয়া, দুই. আদালতে কাজিগিরি বা বিচারকের দায়িত্ব পালন এবং তিন. সম্রাটদের বিভিন্ন রকমের দাতব্য কাজকর্মের তদারকি করা। এ বিষয়ে ইংরেজ ইতিহাসবিদ উইলিয়াম হান্টার লিখেছেন, ‘কাজি অথবা মুসলমান আইনজ্ঞরা দেওয়ানি আদালতে বিচার করতেন। এমনকি আমরা যখন সর্বপ্রথম শিক্ষিত আহলে বিলাতি দিয়ে এ দেশের বিচারকাজ চালানোর চেষ্টা করলাম, তখনো মুসলমান আইনজ্ঞরা আইনের পরামর্শদাতা হিসেবে তাদের সঙ্গে রীতিমতো উঠাবসা করতেন। ইসলামী বিধিব্যবস্থাই এ দেশের আইন-কানুন ছিল এবং সরকারি ছোটখাটো অফিসগুলো মুসলমানদেরই সম্পত্তি ছিল। তারাই সরকারি ভাষা বলতে পারত এবং প্রচলিত ফারসি অক্ষরে লেখা সরকারি নথিপত্র একমাত্র তারাই পড়তে পারত। ইংরেজদের আমলে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়, ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিপ্লবের পর গোটা পাক-ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ বেনিয়াদের চূড়ান্ত আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশরা এসেই মুসলমানদের সমূলে উৎপাটনের জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করে। তারা চিন্তা করে, রাজ্যহারা মুসলমানদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও ধর্মীয় দিক থেকে পঙ্গু ও সর্বস্বান্ত করতে না পারলে মুসলমানরা সুযোগ পেলেই ক্ষমতা দখলের লড়াই শুরু করবে। তাই তারা মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থা আমূল পরিবর্তনে মনোযোগ দেয়। প্রথমেই তারা তৎকালীন সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী শিক্ষামাধ্যম মাদ্রাসা ও মক্তব শিক্ষাব্যবস্থা বন্ধ করার ফন্দি বের করে। ‘বখতিয়ার খিলজির বাংলা জয়ের পর থেকে প্রায় ৫০০ বছর পর্যন্ত সুবে বাংলা ছিল জ্ঞানচর্চার একটি কেন্দ্র। মুসলিম সুবাদার, সুলতান, নায়েব, নাজিমগণ মাদ্রাসা ও খানকার জন্য উদার হস্তে দান করতেন। নগদ অর্থ যা দিতেন, লাখেরাজ সম্পদ দিতেন তার চেয়ে অনেক বেশি। পলাশীর যুদ্ধ, উদয়নালা-বক্সারের পরাজয়ের পর ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির নামেমাত্র মোগল বাদশা শাহ আলম সুবে বাংলার দেওয়ানি বা রাজস্বব্যবস্থার দায়িত্ব বার্ষিক ২৬ লাখ টাকার নজরানার বিনিময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির হাতে তুলে দিতে বাধ্য হন। ১৭৬৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সম্পাদিত নবাব মীরজাফর ও রবার্ট ক্লাইভ চুক্তিমূলে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি নবাব মীরজাফরকে আদায়কৃত রাজস্ব থেকে প্রদান করত ৫৩, ৮৬, ১৩১ টাকা। এ সামান্য টাকার বিনিময়ে বাংলার জনগণের ভাগ্য বিক্রয় হয়ে গেল ইংরেজদের হাতে। ইংরেজরা সুবে বাংলার খাজনা আদায়ের দায়িত্ব পেয়ে লক্ষ করে যে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় ৮০ হাজার মক্তব ও মাদ্রাসা ছিল। মক্তবগুলো ছিলো কওম ভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা এবং কোন বয়স্ক মানুষ যদি পড়তে চাইত তবে তাকে ওস্তাদেরা এখানে পড়াতো। প্রাথমিক মক্তব শিক্ষা শেষ করেই মাদ্রসাতে ভর্তি হত উচ্চ শিক্ষার জন্য। মক্তব গুলো মাঝে মাঝে সরকারি অনুদান পেত তবে মাদ্রাসাগুলো সারা বছরই সরকারি ভাবে চলত যেগুলোকে এখন আলিয়া মাদ্রাসা বলা হয়। ঐ সময়ের কওমী মক্তবের শিক্ষকরা সবাই ছিলো আলিয়া মাদ্রাসার উচ্চ শিক্ষিত ওস্তাদ, দ্বীনি খেদমতে তারা মক্তবে শিক্ষকতা করতো। এই ৮০ হাজার মক্তব, মাদ্রাসা ও খানকার জন্য বাংলার চার ভাগের এক ভাগ জমি লাখেরাজভাবে বরাদ্দ ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি ক্রমেই এই লাখেরাজ সম্পত্তি আইন, বিধিবিধান প্রণয়ন ও জোরজবরদস্তি করে দেশের হিন্দু জমিদার ও প্রজাদের ইজারা দিতে থাকে। এ-সংক্রান্ত তিনটি বিধান হলো: (১) ১৭৯৩ সালের রেগুলেশন—১৯, (২) ১৯১৮ সালের রেগুলেশন—২, (৩) রিজামসান ল অব ১৮২৮ (লাখেরাজ ভূমি পুনঃ গ্রহণ আইন)। ফলে মাদ্রাসার আয় কমতে থাকে। বহু মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যায়। গুটি কয়েক মাদ্রাসা কোনো রকমে অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়। ১৭৬৫ সালে বাংলায় মাদ্রাসার সংখ্যা ছিল আশি হাজার। ২০০ বছর পর ১৯৬৫ সালে এ সংখ্যা দুই হাজারের নিচে নেমে আসে। এ ব্যাপারে হান্টারের বক্তব্য হলো, ‘শত শত মুসলমান পরিবার ধ্বংস হয়ে গেল এবং তাদের শিক্ষাপ্রণালী, যা এত দিন লাখেরাজ ওয়াকেফর জমিজমার ওপর নির্ভরশীল ছিল, মারাত্মক আঘাত পেল। মুসলমান আলিম-সমাজ (ওয়াকেফর জমিজমার মামলা নিয়ে) প্রায় আঠারো বছরের হয়রানির পর একেবারে ধ্বংস হয়ে গেল। ’ (ইন্ডিয়ান মুসলমানস, পৃ. ১২১-১২২) মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ব্রিটিশ ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা কতটা শক্তিশালী ছিল, তা বোঝার জন্য হান্টারের মূল্যায়ন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে। হান্টার লিখেছেন: ‘এ দেশটা আমাদের হুকুমতে আসার আগে মুসলমানরা শুধু শাসন ব্যাপারেই নয়, শিক্ষা ক্ষেত্রেও ভারতের শ্রেষ্ঠ জাতি ছিল। ভারতের যে প্রসিদ্ধ (ইংরেজ) রাষ্ট্রনেতা তাদের ভালোভাবে জানেন, তাঁর কথায়: ভারতীয় মুসলমানদের এমন একটা শিক্ষাপ্রণালী ছিল, যেটা আমাদের আমদানি করা প্রণালীর চেয়ে নিম্ন হলেও কোনো ক্রমেই ঘৃণার যোগ্য ছিল না। তার দ্বারা উচ্চস্তরের জ্ঞান বিকাশ ও বুদ্ধিবৃত্তি পরিচ্ছন্ন হতো। সেটা পুরনো ছাঁচের হলেও তার ভিত্তিমূল সুদৃঢ় ছিল এবং সেকালের অন্য সব প্রণালীর চেয়ে নিঃসন্দেহে উত্কৃষ্ট ছিল। এই শিক্ষাব্যবস্থায়ই তারা মানসিক ও আর্থিক প্রাধান্য সহজেই অধিকার করেছিল। ’ (ইন্ডিয়ান মুসলমানস, পৃষ্ঠা-১১৬) মক্তব ও অসংখ্য আলিয়া শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের পর ইংরেজরা মুসলমান আলেম উলামাদের দাবীর প্রেক্ষিতে পুনরায় কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে।
১৭৮০ সালে মাদ্রাসা স্থাপিত হওয়ার পর ১৭৯০ পর্যন্ত ১০ বছর কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার পাঠ্যতালিকায় তাফসীর, হাদিস, আরবী ব্যকরণ সহ ইসলামী শরিয়তের সকল প্রকার কিতাবের সিলেবাস অনুসরণ করা হয়েছিল। এখান থেকে মুসলমানদের ভিতর আস্তে আস্তে ইসলামের জাগরন এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সুত্রপাত অনুধাবন করে ব্রিটিশরা মাদ্রাসা সিলেবাস থেকে হাদিস, তাফসির অধ্যয়ন উঠিয়ে দেয়।বড়বড় আলেমদের ভিতর ক্ষোভের সৃষ্টি হয় তারা মেনে নিতে পারেনি যে মাদ্রাসা থেকে কোরআন হাদিসের শিক্ষা উঠে যাক। যেহেতু আলিয়া মাদ্রাসা সরকার দ্বারা পরিচালিত হত তাই দ্বীনি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি ধৃষ্টতা প্রদর্শনের জন্য আলিয়া মাদ্রাসার সকল আলেম উলামারা ওখান হতে চলে আসে সাথে মুসলিম ছাত্ররাও অনেকে চলে আসে। ৭৬ বছর পযর্ন্ত মসজীদ, মক্তব, খানকা সহ বিভিন্ন জায়গায় ইংরেজদের ভয়ে এক প্রকার লুকিয়ে লুকিয়ে দ্বীনি শিক্ষা চলতে থাকে এবং ১৮৬৬ সালে তৎকালীন আলেমসমাজের উদ্যোগে ভারতের দেওবন্দে বিশ্বের প্রথম কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। দেওবন্দে এত ছাত্রের জায়গা এবং থাকার সংকুলানের কথা বিবেচনা করে দেশ বরেন্য আলেম উলামা ও কলিকাতা এবং আসে পাশের মুসলমানদের তিব্র দাবীতে ১১৮ বছর পর ১৯০৮ সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় পুনরাই হাদিস, তাফসির শিক্ষা চালু করা হয় এবং সর্বোচ্চ ডিগ্রিকে নাম দেওয়া হয় টাইটেল। ’
ভাবার বিষয়ঃ
১৭৯০ ইং(আলিয়া মাদ্রাসা হতে কোরআন হাদিস উঠিয়ে দেবার সাল) হতে ১৮৬৬ ইং পযর্ন্ত(কওমী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার সাল) সময়ের ব্যবধান ৭৬ বছর। যারা দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা
মুহাম্মদ কাসেম নানুতুবি
হাজী আবেদ হুসাইন
যুলফিকার আলী
ফজলুর রহমান
ইয়াকুব নানুতুবি
রফী উদ্দিন
যাদেরকে আকাবের বলা হয় তাদের সকলের বয়স তখন৫০/৫৫/ ৬০ হতে ৭০ এর কোঠায়, তারা কোথায় লেখা পড়া করেছিলো?উনারা কিন্ত কওমী মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেননি। উনারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ওস্তাদের তত্বাবধানে এবং ব্যক্তি বিশেষের মাদ্রাসায় পড়াশুনা করেছেন। বিশেষ করে ওলী আউলিয়াদের সোহবতে থেকে শিক্ষা লাভ করেছেন। আমরা যদি কাশেম নানুতুবী রহঃ এর জীবনীতে দেখতে পাই তিনি ইউকিলিপড যুক্তিবিদ্যা সহ নানান বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করতেন। আলিয়া মাদ্রাসা হতে যখন কোরআন হাদিস ইংরেজরা উঠিয়ে দিলো তখন বিভিন্ন গোত্রে গোত্রের আলিয়া পড়ুয়া আলেম উলামাদের মাধ্যমেই দ্বীন শিক্ষার কাজ চলছিলো। দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতারা সকল কওমকে একত্র করে দারুল উলুম দেওবন্দের দিকে লেখাপড়ার জন্য আহবান জানালেন। সেখান হতেই দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা কওমিয়া মাদ্রাসা নামে পরিচিত।
কওমী আলিয়ার দ্বন্দ
কওমী এবং আলিয়া মাদ্রাসার ভিতর ঐক্যের অভাব পরিলক্ষিত হয় অতি সম্প্রতি। পূর্বের আলেমদের ভিতর কোন প্রকার অনৈক্য এবং হিংসা ছিলোনা। ছোট খাটো কিছু মতভেদ ছিলো কিন্ত অনৈক্য ছিলোনা। তদানিন্তন যুগে মাদ্রাসায় সন্তানকে পড়ানো হতো আখেরাতে নাজাত এবং পিতামাতার পরিবারের জন্য যেন দোয়া করতে পারে সেজন্য মেধাবী সন্তানটাকেই তখন মাদ্রাসায় পড়ানো হতো। কওমী আলিয়াতে সমমানের আলেম তৈরী হয়ে আসছিলো। সামাজিক সম্মানে আলেমেরা ছিলো সর্বোচ্চ আসনে। পারিবারিক ঐতিহ্য ও সামাজিক ভাবে আলেমদের চাকুরী করতে হবে এমন কোন মানুসীকতা তখনো ছিলোনা। যুগের প্রয়োজনে আলিয়া মাদ্রাসাগুলিতে যখন আখেরাতমুখী লেখা পড়ার পাশাপাশি দুনিয়ামুখী সিলেবাস সংযুক্ত করা হলো তখন সকল ছাত্ররা তাদের উপর বাড়তি চাপের কারণে প্রতিবাদ করেছিলো। পরিশেষে সরকারী নীতি নির্ধারকরা তাদেরকে বোঝাতে সক্ষম হলো যে, দুনিয়াবী কায্যক্রম পরিচালনার জন্য আখেরাতমুখী শিক্ষার পাশাপাশি দুনিয়াবী শিক্ষার প্রয়োজন আছে। মানব সম্পদ বৃদ্ধির সাথে সাথে যখন বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পেলো এবং রাষ্ট্রের নানান ক্ষেত্রে যোগ্যতা সম্পন্ন লোকের প্রয়োজন হলো তখন আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্রদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাকুরীতে প্রবেশের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে গেলো। কওমী মাদ্রাসাগুলিতে যখন আলেমদের সংখ্যার সাথে সাথে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করলো তখন তাদের ভিতর আলিয়ার আলেমদের প্রতি হিংসার সুচনা বৃদ্ধি পেতে থাকলো। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় হতে এই হিংসাত্বক ভাবের প্রভাব সমুহ প্রাতিষ্ঠানিক রুপ ধারন করে। আর এটা শুরু হয় ভারত পাকিস্থান বিভক্তি নিয়ে। দারুল উলুম দেওবন্দের পণ্ডিতদের একটি বড় অংশ ভারত ভাগ করে দুই রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরোধিতা করেন। মাওলানা হুসাইন আহমেদ মাদানি পাকিস্তান ধারণার বিরোধিতাকারী পণ্ডিতদের অন্যতম ছিলেন। এ সময় তিনি মাদরাসার শায়খুল হাদিস হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং আলেমদের সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের নেতৃত্ব দেন। তিনি বলেন, "সবাইকে একটি গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য প্রয়াস চালাতে হবে যাতে হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খ্রিষ্টান ও পারসিরা অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এধরনের স্বাধীনতা ইসলামসম্মত। " দেওবন্দ ধারা ইসলামের প্রাচীন রূপের পৃষ্ঠপোষকতা করে এবং যেকোনো প্রকার সহিংসতা থেকে নিজেকে দূরে রাখে। দেওবন্দ হতে তখন একটি পত্রিকা বের হতো ঐ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদী রহঃ। পাকিস্তান বিভক্তি আন্দোলন চলাকালীন সময় মওলানা মওদুদী রহঃ কে হুসাইন আহাম্মদ মাদানী রহঃ বলেন পত্রিকাতে ভারত বিভক্তির বিরুদ্ধে লেখার জন্য। মওলানা মওদুদী রহঃ তা প্রত্যাখান করে সম্পাদকের দায়িত্ব হতে পদত্যাগ করে। আলিয়া পড়ুয় ছাত্ররা মুসলমানদের জন্য আলাদা সার্বোভৌমত্ব হোক এর পক্ষে তারা আন্দোলন করেছিলো এবং পরিশেষে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান হলো এবং পরবর্তীতে একই দাবীতে বাংলাদেশ হলো। দেওবন্দের জমিয়তে উলামায়ে হিন্দরা কখনো চাইনি মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান বা বাংলাদেশ নামের আলাদা রাষ্ট্র হোক। উভয় দেশ বিভক্তির পর জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়তে থাকে আলিয়া কওমী শিক্ষার হার। রাষ্ট্রভাগের সৃষ্ট মতাদ্বন্দ সর্বশেষ শিক্ষা এবং রাজনীতির উপর শুরু হলো বৈধ অবৈধতার ফতুয়া যা পরবর্তী উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক হতে বিষাক্ত আকার ধারন করে। ইসলামে রাজনীতি হারাম, ইংরেজী শিক্ষা হারাম, দুনিয়াবী শিক্ষা হারাম, এ ধরনের নানান ফতুয়া জাতীর ঘাড়ে চাপতে থাকে। বিংশ শতাব্দীর কওমী উলামারা ক্লাসে তাদের ছাত্রদের এভাবে মটিভেশন করে যে আলিয়াদের সকল বিষয়ের আকিদা ঠিক নেই তাদের কাজ কারবার কুফুরী, এমনকি তাদের রাজনীতিও কুফুরী এসব বলে আলিয়ার ছাত্র শিক্ষকদের প্রতি কওমী নবাগত ছাত্রদের বিষিয়ে তুলতে শুরু করে যা এখনো চলমান। বর্তমান পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। এখন মিডিয়ার যুগ আলিায়ার কোন আলেম যদি বিজ্ঞান ভিত্তিক কোন ওয়াজ নসিহত করে তবে কওমীর ছাত্ররা এমনভাবে কটুক্তি করে যা মাদ্রাসায় পড়ুয়ার পরিপন্থি। আমি বলছিনা এ ক্ষেত্রে আলিয়ার ছাত্ররা ধুয়া তুলসীপাতা তারা প্রতিবাদ করেনা। তবে নিরোপেক্ষ দৃষ্টিতে আমি মিডিয়াতে যতটুকু দেখেছি বর্তমান সময়ে আলিয়া পড়ুয়াদের চাইতে কওমী পড়ুয়াদের ভিতর হিংসা বিদ্বেষের ভাবটা বেশি।
পরিশেষে কওমী আলিয়া সকলের প্রতি আমার উদাত্ত আহবান, বৈরিতা ভূলে গোড়ামী ত্যাগ করে ঐক্যের পথে এসে আল্লাহর রজ্জুকে সকলে এক সাথে ধারন করি আমরা বিচ্ছিন্ন না হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন