মাথাভাঙ্গা,রচনায়ঃকবি আব্দুল হান্নান

মাথাভাঙ্গা, রচনায়ঃকবি আব্দুল হান্নান

মাথাভাঙ্গা

হান্নান

আজ আমার প্রিয় মাথাভাঙ্গা সম্পর্কে কিছু অনুভূতির কথা ব্যাক্ত না করলে মাথাভাঙ্গার অধিবাসী হিসেবে নিজের কাছে বড়ই অপরাধী লাগছে। আমার জীবনের হাজারো স্মৃতি লুকিয়ে আছে এই মাথাভাঙ্গার তীরে।মাথাভাঙ্গাকে আঁড়াল করতে গেলে জীবনটাই যেন আড়াল হয়ে যায়।শৈশব কৈশর যৌবন সবই মাথাভাঙ্গার কোলজুড়ে। ভূলতে পারিনা ছোটবেলার সেই স্মৃতিগুলো যখন গোসলে গিয়ে মাথাভাঙ্গার বুকে বসে উনুই নিয়ে খেলতাম।খেলতে খেলতে কখন যেন দুপর গড়িয়ে যেত।মুরুব্বীরা কান ধরে গোসল করাতো কিযে একটা আনন্দ অনুভব করতাম।মাথাভাঙ্গা তীরের মায়েরা সংসারের হাজারো কাজ সামলিয়ে ক্লান্ত হয়ে বুকু দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে মাথাভাঙ্গার তীরে এসে পানি স্পর্শ করে বসে আগে মুখ ধুয়ে টানা নিঃস্বাস নিয়ে শান্তি অনুভব করে গোসল সারতো।অনেকেই আবার মাথাভাঙ্গার পাড়ের নেকোমাটি দিয়ে মাথাঘষে মাথার চিটে উঠাতো।কপোতীদের হাঁস চরানো আর শুড়শুড়োনীর শাকতোলার দৃশ্যটাও কম মজার নয়।মাথাভাঙ্গার পানি বাড়ার সাথে সাথে সেরেশ্তায় মাছধরার প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে যেত।শেরেস্তার ঘাট পরিস্কার করতে ডুবমারামারীর কৌতুহলী দৃশ্যটা বড়ই মজাদার।মাথাভাঙ্গার কিনারে বাঁশ দিয়ে মাচা করে মাছেদের জন্য মজাদার সব খাবার মিশিয়ে বরশীর সাথে দানাবেঁধে এক দুই তিন গুনে সুতা ধরে দানাটি ফেলে দিত একদম সেরেস্তার ঘাটে।অনেকের আবার হাত ঠিক হতোনা একজনেরটা আর একজনের ঘাটে গিয়ে পড়তো।মাথাভাঙ্গার মাছগুলোও যেন বন্ধুপ্রতিম ওরা একজনের চাঁর খেয়ে আর একজনের বরশীর সুতার সাথে জড়াপটকী বাঁধিয়ে দিত এখন দুজনের সেরেস্তায়ই সুতাটানাটানি কার মাছ এখন কেউ বলতে পারেনা।মাছ একটা চরকী ঘুরছে দুজনের।টানতে টানতে দেখা গেল বরশী খেয়েছে তকবারীর এখন দেলবারী ফক্কা। মাথাভাঙা ২ আব্দুল হান্নন মাথাভাঙ্গা আমার হৃদয়ের টান।গান্ধি লাগলে মাছ ধরার দৃশ্য গুলো অনেক মজাদার,দূরের কুটুমরা ঐ সময় বেশি বেশি মাথাভাঙ্গার পাড়ের আত্মীয় বাড়ী বেশি বেড়াতে আসত।মাথাভাঙ্গার মায়েদের কত প্রকারের মাছ রান্না তার ইয়াত্তা নেই,ঝোলমাছ,ভাজা মাছ,পুড়পুড়ি, চড়চড়ী,অনেক রকমারী রান্না,মাছ ধরতে গিয়ে অনেক দৃশ্য দেখতাম।ভালবাসার মানুষ গুলোর সাথে সাক্ষাতের এই একটা মোখ্খম সময়।কথা কখন বলা যাবে অপেক্ষার এক প্রহর গুনত কপত কপোতিরা।রাতদিন গান্ধি থাকায় তাদের জন্য ভালো ছিল।তবে গার্জিয়ানদের তদারকীতে এ কাজে সময় তারা খুব কমই পেত।ফ্রিজ আবিস্কারের সাথে মাথাভাঙ্গা ও শুকানো শুরু করলো,গান্ধিও বন্ধ হলো। মাথাভাঙ্গা ৩ আব্দুল হান্নান কোথায় গেল মাথাভাঙ্গার সেই য্রৌবন? রজনীর হাঁস তাড়ানোর কথা,ছিপ দিয়ে মাছ ধরার দৃশ্য কি যে একটা মজার সময় জীবন থেকে দূর অতীত হয়ে গেছে যা কখনো ভূলার নয়।নেটোখালীর পাট চাষীরা পাট কেটে মাথাভাঙ্গায় জাগ তৈরী করে জাগের উপর উঠে নগা দিয়ে উজান স্রতে মাল কাছা বেধে জাগ নিয়ে আসার দৃশ্যটা আজকের দুনিয়ায় শ্রেষ্ঠ ক্যামেরা বন্দীর একটা স্মৃতি।মাথাভাঙ্গার পাড়ে গাং শালিক মাটি গর্ত করে বাস করা আর ভোর হলে তাদের কিচির মিচির মনে হতো মাথাভাঙ্গা বাসীদের ঘুম ভাংগীয়ে দিচ্ছে।দুষ্ট পোলাপানরা আবার শালিক গর্তে গেলেই হাতে গামছা বেঁধে ধরা শুরু করতো।মেয়েরা আবার ওখান থেকে নেকোমাটি এনে মাথা ঘসা শুরো করতো।মাথায় তেলচিটে হলে নেকো মাটি দিয়ে ঘসলেই তা দূর হয়ে যায়।রজনীত সব সময় নেকো মাটি দািয়ে মাথা ঘসতো এই জন্য ওর চুলগুলো ভাল ।সব স্মৃতিইতো হারিয়ে যাচ্ছে।মাথাভাঙ্গা থেকে এখন আর কাউকে কিলোসকার দমকলের মেশিন দিয়ে পানি তুলতে দেখা যায়না।আলম ভাই শাবারীর সেই মেশিন কোথায় গেলো?।।। মাথাভাঙ্গা ৪ হান্নান মাথাভাঙ্গার মুরুব্বিরা মাথাভাঙ্গারর তীরে বসে অনেক মজার মজার গল্প বলত।রনী ভাইয়ের একটা গল্প আজ মাথাভাঙ্গায় তুলে ধরবো। একটি ঐতিহাসিক কাহিনী দিয়ে আজকের প্রসঙ্গটি শুরু করা যাক। কাহিনীটির জন্মের স্থান হলো আদিকালের পারস্য দেশের বোস্তামনগরী। আনুমানিক পৌনে বারোশ বছর আগে অর্থাৎ ৮৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৮৭৭ সালের কোনো এক সময়ে ঘটনাটি পুরো বোস্তাম তো বটেই আশপাশের দেশগুলোতেও সাড়া ফেলে দিয়েছিল। সুলতানুল আরেফিন হজরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.) তখন জীবিত। তাঁর মানমর্যাদা, যশ-খ্যাতি এবং প্রভাব প্রতিপত্তি তখন তুঙ্গে। ঠিক এই সময়টিতে বোস্তামনগরে লজ্জাকর একটি ফ্যাসাদ-ফেতনা পুরো সমাজকে গ্রাস করতে বসল। লোকজন কাজকর্ম বাদ দিয়ে সুযোগ পেলেই সমবয়স্কদের নিয়ে জড়ো হয় এবং ফেতনাটির রসঘন কাহিনী নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে। যারা সামর্থ্যবান তারা ফেতনাটির সঙ্গে সখ্য করার জন্য উতালা হয়ে উঠল এবং দরিদ্ররা আফসোস করতে করতে নাফরমানির দিকে এগোতে শুরু করল। সমাজের আলেম-ওলামা এবং নেতৃবৃন্দ হজরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে বললেন —হে আমাদের মোহতারাম! আপনি বলে দিন, আমরা এখন কী করব অথবা আমাদের এখন কী করা উচিত! বোস্তামনগরীতে কোনো দিন এমনতর ফেতনা ইতিপূর্বে হয়নি। এটির মন্দ দিক সম্পর্কেও আমাদের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। ফলে আমাদের চোখের সামনে ফেতনাটি বড় হতে হতে মস্ত বড় এক ফ্যাসাদে পরিণত হয়েছে। এটাকে যদি প্রতিহত না করা হয় তবে আসমানি বালা-মুসিবত পুরো বোস্তামনগরীকে গ্রাস করবে। তখন আমরা খোদায়ী গজব থেকে কেউ রক্ষা পাব না— এমনকি আপনিও পাবেন না। কারণ আমরা শুনেছি কোনো সামাজিক পাপ, অন্যায় এবং অপকর্মকে যদি প্রতিরোধ করা না যায় তবে তার দায় পুরো সমাজকেই বহন করতে হয় আর এই কারণে যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো গজব নাজিল হয় তবে তা সমাজের সবাইকেই সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। হজরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.) আগত আলেম-ওলামা এবং সমাজপতিদের বক্তব্য শুনলেন এবং ফেতনাটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলেন। তিনি আরও জানতে চাইলেন— কেন গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ ফেতনাটি প্রতিরোধ করতে পারছেন না! উপস্থিত লোকজন বললেন, ইয়া হজরত বোস্তামনগরীতে অনিন্দ্য সুন্দরী এক যুবতী রমণীর আগমন ঘটেছে। সে নগরীর অভিজাত এলাকায় প্রাসাদের মতো একটি বাড়িতে রঙ্গমহল খুলে বসেছে। সে ঘোষণা করেছে দুইশ স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে যে কোনো পুরুষ তার সঙ্গে একরাত কাটাতে পারবে। সমাজের উচ্চবিত্ত দু-একজন প্রথম দিকে মহিলাটির সঙ্গে রাতযাপন করে। তারা এসে লোকজনের কাছে মহিলার রূপ, চাকচিক্য এবং পুরুষদের আনন্দ প্রদানের অসাধারণ কৌশল এমনভাবে বর্ণনা করতে থাকে যে, সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা সেখানে যাওয়ার জন্য রীতিমতো হুড়োহুড়ি শুরু করে দেয়। বিষয়টি খুব দ্রুত বিস্তার লাভ করে এবং উচ্চবিত্ত সমাজ ছাড়িয়ে মধ্যবিত্ত সমাজকে আক্রমণ করে। অনেক লোভী এবং চরিত্রহীন পুরুষ ভিটেমাটি, জমি জিরেত এবং ব্যবসাপাতি বিক্রি করে সেই মহিলার সঙ্গে রাতযাপনের জন্য অগ্রিম দুইশ স্বর্ণমুদ্রা পরিশোধ করে খদ্দেরের তালিকায় নাম লিখিয়ে আগ্রহভরে অপেক্ষা করছে। মহিলাটি অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক বনে গেছে। রাজা-বাদশাহ কিংবা আমির-ওমরাহর মতো তার বাড়িটিকে নিরাপদ এবং দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করেছে। বহু সংখ্যক অস্ত্রধারী পাহারাদার নিয়োগ দিয়েছে। সমাজের বিত্তশালী মন্দ লোকেরা তার খদ্দের হওয়ায় শান্তিপ্রিয় নিরীহ লোকের সাধ্য নেই তার বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দটি উচ্চারণ করার। তাকে নিয়ে মানুষের আগ্রহ এবং আকর্ষণ ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছে গেছে। তরুণ এবং যুবকরা মহিলার প্রাসাদের আশপাশে ঘুর ঘুর করে। মহিলার খদ্দেরদের পরিবারগুলোতে হাহাকার শুরু হয়েছে। লোকজন কাজকর্ম ফেলে মহিলার রূপ নিয়ে গল্পগুজবে মেতে ওঠে। এদিকে মহিলাকে এককভাবে পাওয়ার জন্য প্রভাবশালীরা নিজেদের মধ্যে এক বিতর্ক শুরু করেছে, যা পরবর্তীতে মারামারি-দ্বন্দ্ব-সংঘাতে রূপ নিতে পারে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। আলেম-ওলামা এবং শান্তিপ্রিয় লোকজনের সাধ্য নেই মহিলার বিরুদ্ধে কোনো শান্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার। অন্যদিকে, তার খদ্দেররা সবাই বিত্তবান প্রভাবশালী এবং মন্দ চরিত্রের লোক হওয়ার দরুন তাদের বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দটি উচ্চারণ করার শক্তি আমাদের নেই। এ কারণে আমরা আপনার কাছে এসেছি সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য। আমরা জানি আপনার জ্ঞান-বুদ্ধি আমাদের সবার চেয়ে বেশি। আপনার গ্রহণযোগ্যতা, জনপ্রিয়তা যেমন আকাশচুম্বী তেমনি আপনার হুকুমকে অমান্য করার দুঃসাহস বোস্তামনগরীর কোনো অধিবাসীর নেই। একমাত্র আপনার সুপরামর্শ এবং উদ্যোগই আমাদের উদ্ভূত ফেতনা-ফ্যাসাদ থেকে উদ্ধার করতে পারবে। হজরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.) আলেম-ওলামা এবং নেতৃবৃন্দকে আশ্বস্ত করলেন এই বলে যে, তিনি সমস্যাটি সমাধানের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। এরপর তিনি নির্দিষ্ট সময়ে একটি জায়নামাজ নিয়ে মহিলাটির বাড়ির সামনে গেলেন এবং সদর দরজার সামনে তা বিছিয়ে নামাজ পড়া আরম্ভ করলেন। পুরো শহরে হৈচৈ পড়ে গেল। দলে দলে লোক চলে এলো মহিলার বাড়ির সামনে। নিরীহ, শান্তিপ্রিয় উত্সুক জনতার সঙ্গে শহরের গণ্যমান্য লোকজনও এসে ভিড় করল। ঘটনার দিন যেসব কাস্টমার বা খরিদ্দার মহিলার রঙ্গমহলের মেহমানের তালিকায় ছিল তারা নির্ধারিত সময়ে ঘটনাস্থলে এসে হজরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.)-কে সদর দরজায় জায়নামাজে বসে নামাজরত অবস্থায় দেখে ভেবাচেকা খেয়ে গেল। একদিকে দুইশ স্বর্ণমুদ্রা অগ্রিম পরিশোধের দায় এবং অন্যদিকে মহিলার জন্য কামনার আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকার পরও তারা সাহস করে সামনে এগোলো না। আলা হজরতের ভয়ে তারা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষের মতো তামাশা দেখার ভান করতে থাকল। মহিলার বাড়ির বাইরে যে এতসব কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে তা সে টেরও পেল না। নির্দিষ্ট সময় খরিদ্দারের আগমন না ঘটায় এই প্রথমবারের মতো সে ভারি আশ্চর্য হয়ে গেল। সে তার খাস খাদেম এবং খাদেমাকে হুকুম করল সদর দরজায় গিয়ে খরিদ্দারের খোঁজ করার জন্য। তারা ফিরে এসে মহিলাকে জানাল, সদর দরজায় নির্ধারিত কোনো কাস্টমার নেই এবং কেউ আসেওনি। তারা আরও জানাল, একজন বৃদ্ধ দরজায় জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়ছেন এবং অদূরে বহু সংখ্যক উত্সুক জনতা ভিড় করে আছে। মহিলা তাদের পুনরায় হুকুম করল বৃদ্ধের কাছে জেনে আসার জন্য যে, তিনি কেন এসেছেন। একটু পর খাদেম-খাদেমা ফিরে এসে জানাল যে, বৃদ্ধ আপনার সঙ্গে সাক্ষাত্প্রার্থী। মহিলা বলল— আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হলে নির্ধারিত দুইশ স্বর্ণমুদ্রা পরিশোধ করতে হবে— আর উনি যদি সেটা তোমাদের হাতে অগ্রিম হিসেবে পরিশোধ করেন তবে তাকে ভিতরে নিয়ে আসবে এবং তিনিই হবেন আজ রাতে আমার মেহমান। খাদেম-খাদেমার কথা শোনার পর হজরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.) সঙ্গে সঙ্গে দুইশ দিনার পরিশোধ করে জায়নামাজটি নিয়ে মহিলার অন্তঃপুরে ঢুকলেন। মহিলা ওলিকুল শিরোমণি বয়োবৃদ্ধ মহামানবকে দেখে নিজের অজান্তে মনের অন্তরলোকে দারুণভাবে ধাক্কা খেল। ইতস্তত করে সে নিজ থেকে কিছু বলতে সাহস পেল না। হজরত বায়েজিদ বোস্তামী বললেন— মা, আমি আপনার কথামতো দুইশ দিনার পরিশোধ করে এখানে এসেছি। এখন আপনি আমার কথামতো উত্তম করে অজু-গোসলান্তে পাক পবিত্র কাপড় পরিধান করে আমার সামনে আসুন। মহিলা হজরতের আগমনে যতটা না আশ্চর্য হয়েছিল তার চেয়ে বেশি আশ্চর্য হয়ে গেল তার কথা শুনে। সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় এবং বলতে গেলে অনেকটা বাকরুদ্ধ হয়ে মাথা নিচু করে হজরতের হুকুম তামিল করল। হুজুর এরপর তাকে জায়নামাজে বসার নির্দেশ দিলেন এবং তার সঙ্গে আল্লাহর দরবারে হাত তোলার কথা বললেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো হজরত বায়েজিদ বোস্তামীর হুকুম মতো মহিলা জায়নামাজে বসে পড়লেন এবং হাত তুললেন। হুজুর দোয়া করলেন— ‘ইয়া আল্লাহ! আমার দায়িত্ব শুধু দাওয়াত পৌঁছানো এবং তুমি হলে হেদায়েতের মালিক। এই মহিলা যেভাবে অর্থ উপার্জন করছে তা তাকে তোমার জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তুমি তাকে দয়া করে হেদায়েত দাও এবং জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও।’ হজরত বায়েজিত বোস্তামী (রহ.)-এর দোয়া মহিলার মনে বজ্রপাতের মতো রেখাপাত করল। সে চিৎকার করে কেঁদে উঠল এবং আপনা হতে নিজের কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে লাগল। এ ঘটনার পরের দিন থেকে বোস্তামনগরী ফেতনামুক্ত হয়ে গেল। উপরোক্ত কাহিনীর মধ্যে শিরোনামের বিষয়বস্তু আলোচিত হয়ে গেছে। আমাদের সমাজের সাম্প্রতিক ফেতনা-ফ্যাসাদ কেবল একটি কিংবা দুটি ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। হাজার রকমের অনিয়ম, অনাচার, ব্যভিচার, ঘুষ, দুর্নীতি, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, প্রতারণা, জাল-জালিয়াতি, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট প্রভৃতি পাপ সমাজকে অক্টোপাসের মতো চেপে ধরেছে। অন্যদিকে ধর্ম-কর্ম নিয়েও শুরু হয়েছে নতুন ফেতনা-ফ্যাসাদ। একদল লোক বলছে— আমরা ধর্ম মানি না। অন্য দল বলছে— আমরা মানি তবে নিরপেক্ষভাবে মানি। ধর্মের যেসব কঠোর অনুশাসন সমাজকে ইসলামের পথে নিয়ে যাবে ওসব আমরা অনুসরণ করব সতর্কভাবে যেন অন্যরা কষ্ট না পায়। এক দল তো আল্লাহকে অস্বীকার করে নাস্তিকতার পথের যাত্রী হয়ে নিজেকে প্রগতিশীল ভেবে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে। এর বাইরে আবার কিছু লোকের সৃষ্টি হয়েছে যারা নিজেদের খোদাদ্রোহী ঘোষণা করে সব ধর্মের বিশ্বাসী লোকজনকে অশ্লীল বাক্যবাণে এবং কুরুচিপূর্ণ লেখনীর মাধ্যমে টিটকারি করছে। এদের মোকাবিলা করার জন্য একশ্রেণির উগ্রবাদ পয়দা হয়ে গেছে বিশ্বাসীদের মধ্যে। তারা তাদের ধর্মের অমিয় বাণী, নির্দেশনা এবং ইতিহাসের ঐতিহ্যের আলোকে ব্যবস্থা না নিয়ে নিজেদের ক্রোধ এবং বিচার বুদ্ধির আলোকে খোদাদ্রোহীদের নির্মূল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষের মন-মানসিকতা, দেহ এবং খাদ্য নানা পাপাচারের কলঙ্ক বহন করছে। নিজে পাপ না করেও পাপের অংশীদার হয়ে যাচ্ছে। ব্যক্তির পাপ পরিবারকে গ্রাস করেছে। তারপর সমাজ এবং রাষ্ট্রকে পাপাচারে আবদ্ধ করে ফেলেছে। এখন প্রশ্ন হলো— এই মহাসর্বনাশ কীভাবে শুরু হয়েছিল এবং কারা শুরু করেছিল! হজরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.)-এর কাহিনীর মতো যে কোনো পাপ সর্বপ্রথম শুরু হয় কোনো পাপীর ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং আগ্রহের ফলে। সমাজ যদি পাপকে ঘৃণা না করে এবং পাপ প্রতিরোধে কঠোরতা অবলম্বন না করে তবে তা যে কোনো জীবাণুবাহিত রোগ যথা কলেরা, গুটি বসন্ত, প্লেগ ইত্যাদির চেয়েও ভয়ঙ্কর বেগে বিস্তার লাভ করে। চূড়ান্ত পর্যায়ে রাষ্ট্র যদি পাপীকে প্রশ্রয় দেয় কিংবা পাপী কর্তৃক পরিচালিত হয় তবে জাতির জন্য অনিবার্য বালা-মুসিবত কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র। অতীতে পৃথিবীর কোনো জনপদে যখন আসমানি বালা-মুসিবত নাজিল হয়েছে তখন সেই আজাব থেকে কেউ রক্ষা পায়নি। নীরবে ইবাদত করে যাওয়া ধার্মিক, গা বাঁচিয়ে চলা নিরীহ প্রকৃতির লোকজন, ভীতু প্রকৃতির জ্ঞানী ও বিবেকবান মানুষ, স্বার্থপর সৎ লোকজন এবং নির্বোধ আমজনতা থেকে শুরু করে বনজঙ্গলের জন্তু জানোয়ার, কীটপতঙ্গ পাক-পাখালি, গাছপালা এবং অবোধ মানব শিশু সবাই আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তওবার দরজা বন্ধ হয়ে যায়— শত চেষ্টা করেও ফিরে আসা যায় না। যেমন ফেরাউন, দ্বিতীয় রামেসিসও পারেনি। লোহিত সাগরের মধ্যে খোদায়ী কুদরতে সৃষ্টি হওয়া পথে ঘোড়া ছুটিয়ে সে যখন সসৈন্যে হজরত মূসা (আ.)-কে অনুসরণ করতে থাকল ঠিক তখন খোদায়ী গজব তাকে পাকড়াও করল। সে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল— আমি ইমান আনলাম মূসার খোদার ওপর— কিন্তু কোনো কাজ হলো না কারণ তখন তওবার দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বালা-মুসিবত থেকে বাঁচার উপায় হলো ফেতনা-ফ্যাসাদকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করা। ব্যক্তির উচিত ফেতনা-ফ্যাসাদ থেকে দূরে থাকা এবং ওগুলোকে পরিহার করা। সমাজের উচিত ফেতনা-ফ্যাসাদকে ঘৃণা করা এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলা। অন্যদিকে রাষ্ট্রের উচিত সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ফেতনা-ফ্যাসাদসমূহকে নির্মূল করা। আর এসব যদি সময় মতো করা না হয় তবে ব্যক্তি পর্যায়ে আপতিত বালা-মুসিবত পরবর্তীতে সমাজকে ধ্বংস করে দেয় এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে আক্রমণ করে দেশ ও জাতিকে। খোদায়ী গজবে ব্যক্তি ধ্বংস হওয়ার উত্তম উদাহরণ হলো হজরত মূসা (আ.) জমানার ধনাঢ্য ব্যক্তি কারুন। সমাজ ধ্বংস হওয়ার প্রকৃষ্ট উদাহরণ কওমে লুত (আ.)। আদ ও সামুদ জাতির ধ্বংসের ইতিহাসের মধ্যে জাতিসত্তা বিলীন হওয়ার উদাহরণ রয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন